শনিবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ুর প্রভাবে উপকূলে মরছে গাছ, লবণাক্ততার থাবায় বিপন্ন সবুজ বেষ্টনী

এ বি রহমান
জুন ৩০, ২০২৫ ১:৪৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে একের পর এক গাছ মরে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণাক্ততা বাড়ায় গাছের শিকড় পচে যাচ্ছে, ফলে ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরছে উপকূলীয় এলাকার নানা প্রজাতির গাছগাছালি। এতে বন ও জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি উপকূলের কোটি মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়েছে।

সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার—এই সব লবণাক্ত উপকূলীয় জেলায় রাস্তার ধারে ও বাগানে হাজারো গাছ শুকিয়ে মরছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির অতিরিক্ত লবণাক্ততা (ppt বৃদ্ধি) এবং তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তনই এর মূল কারণ।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন আহমেদ বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবনে এখন আর ছয় ঋতুর প্রভাব নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখানে কার্যত শুধু দুই ঋতু—গ্রীষ্ম ও শীত—রয়েছে। এই পরিবর্তন ঠেকাতে সরকারকে এখনই বড় পরিসরে জলবায়ু অভিযোজনমূলক প্রকল্প নিতে হবে।”

তার মতে, পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে আগামী দশ বছরের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে ঋতুচক্র ও পরিবেশ ভারসাম্য কিছুটা পুনরুদ্ধার সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতেও। সৈকতের তীর ঘেঁষে সারি সারি ঝাউ ও কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এখন বিবর্ণ, পাতাহীন ও শুষ্ক হয়ে পড়ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, কয়েক বছর আগেও সৈকতের দুই পাশে ঘন সবুজ বেষ্টনী ছিল, এখন অনেক জায়গায় গাছ নেই বললেই চলে।

কুয়াকাটার গঙ্গামতি এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, “সৈকতের কেওড়া ও ঝাউগাছগুলো আগে সবুজে ভরা ছিল। এখন প্রথমে লালচে হয়, পরে পাতা ঝরে পড়ে—শেষে গাছ মরে যায়। মনে হয় লবণাক্ত পানিই এর মূল কারণ।”

পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে উপকূলে প্রায় ৭ হাজার ৭০৯ একর এলাকায় বনায়ন করা হয়। ১৯৮২–৮৩ সালে তা বেড়ে ১ লাখ ১২ হাজার একর হয়। বর্তমানে উপকূলীয় বনভূমির পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার একর, যার মধ্যে পটুয়াখালী জেলায় রয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার একর বনায়ন।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব রাব্বানী বলেন, “গাছ মরে যাওয়ার দুটি প্রধান কারণ—অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও বালু জমে শিকড়ের শ্বাসমূল বন্ধ হয়ে যাওয়া। এতে গাছের শিকড় পচে যায়, পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত গাছটি মরে যায়।”

এ বিষয়ে পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানান, তিনটি কারণে গাছ মারা যেতে পারে—জোয়ারের পানিতে বালু জমে শ্বাসমূল বন্ধ হওয়া, দীর্ঘ খরায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও অতিবৃষ্টিতে শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলের গাছগাছালি ধ্বংস হলে এর প্রভাব পড়বে স্থানীয় আবহাওয়ার ওপরও। বন না থাকলে গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপদাহ ও শীতে তীব্র ঠান্ডা দেখা দেবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনে, কৃষিতে ও জীববৈচিত্র্যে।

“লবণ সহনশীল গাছ লাগানো এখনই শুরু করতে হবে, নইলে উপকূলের সবুজ বেষ্টনী হারিয়ে যাবে,”—বলেছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।