বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্রমেই বেড়ে চলছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা। এর ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে দেশের শিশু ও কিশোরদের ওপর—যারা জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে উঠছে নিঃশব্দে।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে উপকূলের শিশুরা
বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯ জেলার ৮৭টি উপজেলার মানুষ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ভোগ করছে। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এসব এলাকার মানুষ বারবার ঘরহারা হচ্ছে। সবচেয়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে নবজাতক ও কিশোর শিশুরা—যাদের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদা আতঙ্কে থাকে পরিবারগুলো।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন আ খ ম মোস্তফা জামান বলেন, “জলবায়ুর পরিবর্তন এখন অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। প্রকৃতির এই অনিয়মিত আচরণে শিশুদের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
খাবার, পানি ও আশ্রয়ে চরম সংকট
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিকারেও।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে; এর মধ্যে ৪৫ লাখ শিশু বসবাস করে উপকূলীয় এলাকায়। প্রতিষ্ঠানটির শিশু ঝুঁকিসূচক সূচকে (Children’s Climate Risk Index) ১৬৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম।
দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত, শহরে নতুন দুঃস্বপ্ন
প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে হাজারো শিশু। তারা পরিবারসহ চলে যাচ্ছে শহরের বস্তিতে, যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টি, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে—সবকিছুই তাদের ঘিরে ধরছে।
এসডো’র সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “উপকূলীয় শিশুদের দুর্দশা শুধু প্রকৃতির না, সামাজিকও। বস্তির গাদাগাদি জীবনে তারা স্বাস্থ্যকর খাবার, শিক্ষা ও নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে শিশুমৃত্যু ও রোগব্যাধি বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে।”
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অপুষ্টির শিকার শিশুরা
মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শিশুদের মধ্যে খর্বাকৃতির হার ২৮ শতাংশ এবং মারাত্মক কম ওজনের হার ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; জাতীয় ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।”
বাল্যবিয়ে ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে শিশুরা কেবল শারীরিক নয়, মানসিক ঝুঁকিতেও রয়েছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বর্তমানে ১৫–১৭ বছর বয়সী নারীর ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বিবাহিত, আর ২০–২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৫ বছর বয়সের আগেই বিবাহিত ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, গড়ে প্রতি মাসে ৮৪ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে—যা তাদের মানসিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অরক্ষিত দেশ। ইতিমধ্যে দেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু অভিবাসী হিসেবে স্থানচ্যুত হয়েছে; ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার লড়াই
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিবৃষ্টি, দীর্ঘ গরম, তীব্র শীত, বজ্রপাত ও মৌসুমি অনিয়ম বাড়ায় শিশুরা আগের চেয়ে বেশি অসুস্থ হচ্ছে। জলবায়ু অভিবাসনের ফলে তারা শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতা চললে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন ব্যাহত হতে পারে।
শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আগামী ২০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ৩২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এর সঙ্গে শিশুমৃত্যুর হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে।”
বাংলাদেশের শিশুদের জন্য তাই জলবায়ু পরিবর্তন আর ভবিষ্যতের হুমকি নয়—এটি বর্তমানের বাস্তবতা।