রবিবার, ১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা: উপকূলের নারীরা সবচেয়ে বিপদে

আব্দুল মতিন
জুলাই ১, ২০২৫ ৫:৩৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বাংলাদেশ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চল—যেখানে বারবার ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততা জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভুগছেন এখানকার নারীরা—যাদের স্বাস্থ্য, জীবিকা ও প্রজনন নিরাপত্তা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ আঘাতে টালমাটাল।

জার্মান ওয়াচ গ্লোবালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক থেকে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। সেই পানি দিয়ে রান্না, গোসল, কৃষিকাজ ও গবাদিপশু পালন—সবই করতে হয় স্থানীয় নারীদের।
ফলে তারা চর্মরোগ, লিউকোরিয়া, প্রজননসংক্রান্ত নানা জটিলতা ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গৃহবধূ রহিমা খাতুন বলেন, “প্রতিদিন লবণাক্ত পানি ছুঁই। হাত-পা জ্বলে, শরীরে ফুসকুড়ি হয়। কিন্তু মিষ্টি পানি পাব কোথায়?”

স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, লবণাক্ত পানির প্রভাবে উপকূলের নারীদের জরায়ু সংক্রান্ত রোগ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে—সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলের গ্রামগুলোতে অনেক নারী জরায়ুর রোগে আক্রান্ত হয়ে অস্ত্রোপচারের মুখে পড়ছেন।
কেউ কেউ বলেন, অস্ত্রোপচারের পর স্বামী তাদের পরিত্যাগ করছেন, যা সামাজিক ও মানসিক বিপর্যয় বাড়াচ্ছে।

২০১৮ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়, মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণাক্ত পানিতে ধোয়ার কারণে নারীদের সংক্রমণ ও জরায়ু রোগের হার বহুগুণ বেড়েছে।
আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি গ্রহণের কারণে উপকূলীয় নারীদের মধ্যে গর্ভপাতের হার দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি।

ইউএনডিপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—উপকূলীয় নারীদের দৈনিক লবণ গ্রহণের মাত্রা গড়ে ১৬ গ্রাম, যেখানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ দেয় দিনে পাঁচ গ্রামের বেশি নয়।
এই অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে গর্ভবতী নারীরা উচ্চ রক্তচাপ, খিঁচুনি, গর্ভপাত ও অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকিতে পড়ছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, এটি এখন একটি “জলবায়ু–স্বাস্থ্য সংকট”, যার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পুরুষরা যখন বিকল্প কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছেন, তখন গ্রামে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বহুগুণে।
২০১৭ সালের কৃষি জরিপ অনুযায়ী, গত দুই দশকে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ।
কিন্তু উপকূলীয় জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে, এতে নারীদের আয়ের পথও সংকুচিত হচ্ছে।
চিংড়ির পোনা ধরা, মাছের ঘেরে কাজ করা, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ—এসব কাজেও নারীরা লবণাক্ত পানির সরাসরি সংস্পর্শে থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (BCCT) এর মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ, গভীর নলকূপ স্থাপন, প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৯–২০২৪ মেয়াদি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে খুলনা ও সাতক্ষীরার পাঁচটি উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়নের প্রায় সাত লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
প্রকল্পের আওতায় নারীদের জলবায়ু–সহিষ্ণু জীবিকার প্রশিক্ষণ, বাজার–সংযোগ উন্নয়ন ও দুই লাখের বেশি মানুষের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলের নারীরা শুধু ভুক্তভোগী নন, তারা জলবায়ু অভিযোজনের অগ্রভাগেও রয়েছেন।
পরিবার ও সমাজ টিকিয়ে রাখতে তারা একদিকে জীবিকা রক্ষা করছেন, অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে লড়ছেন।

পরিবেশ বিশ্লেষক ফরিদা ইয়াসমিনের ভাষায়— “জলবায়ু পরিবর্তনের যুদ্ধে নারীরাই সামনের সারির সৈনিক। তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও জীবিকা–নিরাপত্তায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখা।”

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন ও গণমাধ্যমও এখন জলবায়ু–সংবেদনশীল এলাকায় সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কমিউনিটি মিডিয়া, স্থানীয় রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জনমত তৈরি করা গেলে নারীর স্বাস্থ্য ও জীবিকা রক্ষায় প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কেবল পরিবেশগত নয়—এটি এক মানবিক ও লিঙ্গ–বৈষম্যমূলক সংকটও বটে।
উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও জীবিকার সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
কারণ, জলবায়ুর এই যুদ্ধ শুধু উপকূলের মানুষের নয়—এটি পুরো জাতির টিকে থাকার লড়াই।