শনিবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হুমকিতে খুলনা অঞ্চলের কৃষি

মো: শামসুল আলম
আগস্ট ৩০, ২০২৫ ৪:৪৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনা অঞ্চলের কৃষি এখন গভীর সংকটে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার কারণে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলার কৃষকরা দিশেহারা। ভাদ্র মাস শেষ হলেও এখনো অনেক জমিতে আমন রোপণ সম্ভব হয়নি। ভারি বৃষ্টি ও বাঁধ ভেঙে বীজতলা নষ্ট হওয়ায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন প্রত্যাশিত ফলন নিয়ে।

উপকূলবর্তী বাগেরহাট ও খুলনা জেলার বহু খালে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ইজারার নামে দখল, দূষণ ও লবণপানি তোলার কারণে খালগুলো ভরাট হয়ে পড়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন না হয়ে কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। চিংড়ি চাষের জন্য খালে বাঁধ দেওয়ায় জোয়ারের সময় উল্টে লবণপানি জমিতে ঢুকে পড়ে— এতে কৃষকরা ধান চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

কয়রা উপজেলার মাদারবাড়ি ও লক্ষীখোলা বিলের কৃষক নূরুল ইসলাম ও ইউনুস আলী জানান, “ভারী বৃষ্টিতে আমাদের ৮০ শতাংশ বীজতলা নষ্ট হয়েছে। নতুন বীজতলা তৈরি করতে হয়েছে, কিন্তু এখনো পানি কমছে না।”

খুলনা অঞ্চলে চলতি অর্থবছরে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮০২ হেক্টর জমি। এর মধ্যে খুলনা ৯৪,৮১০ হেক্টর, বাগেরহাট ৭৩,৩২২ হেক্টর, সাতক্ষীরা ৮৮,৭৭০ হেক্টর ও নড়াইল ৪২,৯০০ হেক্টর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট অগ্রগতি ৯৩ শতাংশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সময়মতো আমন রোপণ ব্যাহত হওয়ায় ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অতিরিক্ত বৃষ্টি, বাঁধ ভাঙা ও জলাবদ্ধতায় খুলনা কৃষি অঞ্চলে আগস্টের শেষ দুই সপ্তাহে ৮৪২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চার জেলায় মোট ১২,৮৬১ জন কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এর মধ্যে: ২,৮৪৫ কৃষকের ১৩৬ হেক্টর বীজতলা নষ্ট (ক্ষতি ৬৮.৬ কোটি টাকা),  ২,৯৮০ কৃষকের ১,৫৭৩ হেক্টর রোপা আমন নষ্ট (ক্ষতি ৬১ লাখ টাকা), ৪,৭২৬ কৃষকের ১৪৪ হেক্টর সবজি ক্ষতি (ক্ষতি ৫.৩৮ কোটি টাকা)।

বাগেরহাটের রামপালের কৃষকরা বলেন, “সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় আমাদের জমিতে লবণপানি ঢুকছে। লবণাক্ততার কারণে ফসল, গাছপালা ও মাছের উৎপাদন কমছে। মিঠা পানির অভাবে কৃষি টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।”

বটিয়াঘাটার কৃষক শাহাদাত হোসেন জানান, “বিলম্বে আমন রোপণ করতে হচ্ছে, ফলে তরমুজসহ পরবর্তী ফসলের সময়মতো উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এতে দামও ভালো পাওয়া যায় না।”

গত ২৯ আগস্ট পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে ভদ্রা নদীর ৩০০ ফুট বাঁধ ভেঙে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে ৯৫০ হেক্টর আমন ক্ষেত ও ২২৫ হেক্টর বীজতলা নষ্ট হয়েছে। কৃষি দপ্তর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তিন মেট্রিক টন বীজ সরবরাহ করেছে।

আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য বলছে, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ধরণ গত কয়েক বছরে ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। কখনও অতিবৃষ্টি, আবার কখনও দীর্ঘ অনাবৃষ্টি হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে কয়রায় জুনে ১৩৯ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৩৪৫ মিলিমিটার ও আগস্টে ৯৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়— যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ বলেন, “বৃষ্টিপাতের এই অস্বাভাবিকতা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। তাই গাছ লাগানোর বিকল্প নেই।”

খুলনা কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক বিভাষ চন্দ্র সাহা জানান, “রোপা আমনের শতভাগ আবাদ সম্পন্ন হলে ৮.৭১ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন সম্ভব হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় প্রণোদনা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাশ বলেন, “খালের বাঁধ, নেট-পাটা অপসারণ, খাল খনন ও স্লুইসগেট সংস্কার করলে কয়রা-পাইকগাছার কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে।”

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এওসেড-এর প্রধান নির্বাহী শামীম আরেফিন বলেন,
“বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২.২ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে— যা শঙ্কার বিষয়। খুলনা অঞ্চলে কৃষকরা সময়মতো আমন চাষ করতে না পারা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রমাণ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।”

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, “খালে বাঁধ ও নেট-পাটা দিয়ে পানি প্রবাহে বাধা দিলে তা শুধু খালই নয়, আশপাশের বিল ও কৃষিজমিরও মৃত্যু ডেকে আনে।”

কয়রা উপজেলা কৃষি অফিসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে— খালের নোনা পানি রোধ ও খননের মাধ্যমে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করা গেলে বছরে প্রায় ৩৭০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন সম্ভব।
এছাড়া: অকেজো ৬টি স্লুইসগেট পুনর্নির্মাণ, নতুন ৪টি স্লুইসগেট স্থাপন, ৩৯টি খাল খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, “জেলায় ২২ হাজার ৬০০ কৃষককে বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। কয়েকটি খাল খনন সম্পন্ন হয়েছে, বাকিগুলোর তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।”

খুলনা অঞ্চলের কৃষি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব চাপে। একদিকে অতিবৃষ্টি ও বাঁধ ভাঙা, অন্যদিকে খরায় সেচের অভাব— দুয়ের মাঝেই টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর জল ব্যবস্থাপনা, খাল পুনঃখনন ও কৃষিবান্ধব নীতি না নিলে এ অঞ্চলের কৃষি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।