শনিবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে কপ–৩০ : নির্ভরতার সন্ধানে দিশেহারা বিশ্ব

ইমন হোসেন
জুলাই ২৫, ২০২৫ ৪:৩৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বিশ্ব এখন এমন এক সংকটময় সময় পার করছে, যখন প্রকৃতির ভারসাম্য ভেঙে পড়ার লক্ষণ প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, খরা, নদীভাঙন, হিমবাহ গলন কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বাস্তব ও যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুর্যোগের সবচেয়ে বড় শিকার হবে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো, যাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাংলাদেশ

ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ সব সময়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বদ্বীপভূমি, ঘনবসতি ও দীর্ঘ উপকূলরেখা—সব মিলিয়ে এখানকার জনগোষ্ঠী জলবায়ুজনিত ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি।
দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, ঘন ঘন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, যা দেশের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

কপ–৩০: মোড় ঘোরানো সম্ভাবনা

চলতি বছর দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত হবে জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ–৩০’। পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আমাজন বনের কাছাকাছি এই সম্মেলনের আয়োজনকে প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
‘পৃথিবীর ফুসফুস’খ্যাত এই বনাঞ্চল বিশ্ববাসীর কাছে এক বার্তা দিচ্ছে—প্রকৃতির সুরক্ষা আর বিলাসিতা নয়, এটি এখন টিকে থাকার শর্ত।

আলোচনার অগ্রাধিকার

কপ–৩০–এ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এবার এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে প্রাধান্য দিচ্ছে, যা বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক জলবায়ু উদ্যোগে নতুন দিগন্ত খুলবে—

ক্ষতিপূরণ তহবিল: জলবায়ু পরিবর্তনে কম দায়ী অথচ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য আর্থিক সহায়তা তহবিল প্রতিষ্ঠা।

জ্বালানি রূপান্তর: জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য শক্তি—সূর্য, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ ব্যবহারের দ্রুত সম্প্রসারণ।

অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা: উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত সহায়তা বাস্তবে কতটা কার্যকর, তার কঠোর মূল্যায়ন ব্যবস্থা।

ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অধিকার: দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য পুনর্বাসন ও সামাজিক সুরক্ষার কৌশল নির্ধারণ।

বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও অবস্থান

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অভিযোজন পরিকল্পনা ও জলবায়ু তহবিল গঠনের মাধ্যমে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তবে সীমিত সম্পদ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এসব উদ্যোগ টেকসই নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কপ–৩০–এ কিছু জরুরি দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা উচিত, যেমন—
সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা
জলবায়ুজনিত অভিবাসীদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
উপকূলীয় জনগণের পুনর্বাসনে সহায়তা
উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি ও জ্ঞান হস্তান্তর

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী দেশগুলো তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ দায়হীন দেশগুলো আজ টিকে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত।
এই বৈষম্য দূর করা এখন একটি বৈশ্বিক নৈতিক দায়িত্ব। কপ–৩০ যেন শুধু বক্তৃতা বা প্রতিশ্রুতির আসর না হয়ে, কার্যকর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাস্তব পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়—এটাই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।

একবিংশ শতাব্দীর এই চরম বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো বিকল্প নয়; এটি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।
বিশ্ব নেতৃত্ব যদি প্রকৃতিকে সঙ্গী করে উন্নয়নের নতুন পথ রচনা করতে চায়, তবে কপ–৩০–ই হতে পারে সেই পরিবর্তনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।

“প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে নয়, প্রকৃতিকে সঙ্গী করেই নির্মিত হোক আগামী পৃথিবী।”