রবিবার, ১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু সংকটে কমছে পৃথিবীর ‘অক্সিজেন ভাণ্ডার’

মোহাম্মাদ ওমর ফারুক
জুন ৩০, ২০২৫ ৫:০৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ নয়—এটি ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রাণভিত্তিক উপাদান, অক্সিজেনের ভাণ্ডারকেও হুমকির মুখে ফেলছে। সমুদ্র ও বনভূমি পৃথিবীর প্রধান অক্সিজেন উৎস। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিতে অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে—যা সামুদ্রিক প্রাণীকুলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (IPCC) জানিয়েছে, সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। কিন্তু এই ভারসাম্য এখন বিপর্যস্ত। উষ্ণ পানি কম অক্সিজেন ধারণ করতে পারে—ফলে মাছ, প্রবালসহ অসংখ্য জীব প্রজাতি বেঁচে থাকার সংকটে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী বলেন, “গত ৫০ বছরে মহাসাগরে অক্সিজেন কমে যাওয়ার হার চারগুণ বেড়েছে। এমনকি যেসব অঞ্চলে কার্বন নিঃসরণ তুলনামূলক কম, সেখানেও এই হ্রাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে সমুদ্রের প্রথম এক হাজার মিটার গভীরতায়—যেখানে জৈববৈচিত্র্যের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। অক্সিজেনের ঘাটতিতে সামুদ্রিক খাদ্যচক্র বিপর্যস্ত হতে পারে।”

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিখাত ও শিল্প-কারখানা থেকে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সমুদ্রে মিশে গিয়ে পুষ্টিদূষণ ঘটাচ্ছে। এতে সমুদ্রের পানির রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা অক্সিজেনের ঘাটতিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

অন্যদিকে, গাছপালা ধ্বংসের প্রভাবও ভয়াবহ। বনের গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন তৈরি করে। কিন্তু নির্বিচারে বনভূমি উজাড় ও নগরায়ণের কারণে পৃথিবীর “সবুজ ফুসফুস” দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। “একটি গাছ, একটি প্রাণ”—এই বাস্তব বোধটি আমরা ভুলে যাচ্ছি বলেই, বিপন্ন হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব।

সম্প্রতি জর্জিয়া টেক ও তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে অক্সিজেনের আয়ু একশ কোটি বছরের বেশি নয়। গবেষকদের মতে, সূর্যের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়বে, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে অতিরিক্ত উষ্ণ করে তুলবে। এতে গাছপালা বাঁচবে না, আর গাছ না থাকলে অক্সিজেন উৎপাদনও বন্ধ হবে। গবেষণা বলছে, আজ থেকে প্রায় ১১০ কোটি বছর পর পৃথিবীতে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে আসবে ১ শতাংশেরও নিচে।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সূর্যের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত হবে। এতে পৃথিবীর শিলাচক্রের পরিবর্তন ঘটবে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাস পাবে। ফলস্বরূপ, গাছ অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারবে না—আর প্রাণীজগৎ হারাবে বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান।

যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সট্রিম এনভায়রনমেন্ট ল্যাবরেটরির প্রধান মাইক টিপটন বলেন, “অক্সিজেন শূন্যতার অর্থ হলো জীবনের শেষ সীমা। মানুষের শরীরে অক্সিজেনের মজুত খুবই সীমিত; কয়েক লিটারের বেশি নয়। এক ঘণ্টা অক্সিজেনহীন পরিবেশে কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব।”

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতি মিনিটে প্রায় এক লিটারের এক-পঞ্চমাংশ অক্সিজেন গ্রহণ করে। কিন্তু কঠোর ব্যায়ামের সময় তা বেড়ে চার লিটার পর্যন্ত হতে পারে।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস জানায়, ২০২১ সালে ক্রোয়েশিয়ার নাগরিক বুদিমির সোবাত পানির নিচে টানা ২৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে থাকার রেকর্ড গড়েছিলেন। তবে গবেষকরা সতর্ক করেছেন—এটি ব্যতিক্রম, স্বাভাবিক জীবনে অক্সিজেনের ঘাটতি মানেই জীবন সংকট।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, বন ধ্বংস ও দূষণের কারণে পৃথিবীর ‘অক্সিজেন ভাণ্ডার’ ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। এখনই যদি প্রকৃতি সংরক্ষণ ও কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়—তাহলে আগামী প্রজন্মের সামনে দাঁড়াবে অস্তিত্বের সংকট।