বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব শুধু পরিবেশ নয়, গভীরভাবে আঘাত হানছে অর্থনীতিতেও। উন্নয়নশীল বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীতে এসে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি। কৃষি থেকে শুরু করে শিল্প ও অবকাঠামো—সব ক্ষেত্রেই এর বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে জলবায়ুজনিত দুর্যোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস কিংবা নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছরই বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপিতে বছরে প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে—যে দেশে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশেরও বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে এ খাতে জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চালের উৎপাদন কমেছে ১.২৮ শতাংশ এবং গবাদিপশু থেকে আয় হ্রাস পেয়েছে ০.১৭৬ শতাংশ। অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন সূচকও নিম্নমুখী। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে বাড়ছে চাপ।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (FAO) তথ্য বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে বোরো ধানের উৎপাদন ১৭ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। পাশাপাশি পেঁয়াজ, রসুন, আলুসহ অর্থকরী ফসলও ক্ষতির মুখে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের অনিয়মিততার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
কৃষি জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান মিলন বলেন, ‘ছোট আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে অভিযোজনমূলক প্রযুক্তি ও নীতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।’
বিশ্বজুড়ে রেকর্ডভাঙা তাপদাহ, বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে জানিয়েছেন—তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৯ লাখ কোটি থেকে ৫৯ লাখ কোটি ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে।
ইউরোপিয়ান ইকোনমিক ফোরাম জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়বে। আগামী কয়েক দশকে অধিকাংশ দেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। মানবাধিকার সংগঠন ডিআরএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.২ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা সীমিত, কিন্তু বৈশ্বিক উদ্যোগ ছাড়া এ সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততার বিস্তার—সবই জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব।’
অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ মনে করেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় ও দূষণ যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে পুরো পৃথিবী অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাই জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপগুলো এখনই কার্যকর করা জরুরি।’
ভূমি হলো জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিয়ামক। কিন্তু অতিরিক্ত চাষাবাদ, রাসায়নিক ব্যবহার, প্লাস্টিক দূষণ ও খরার কারণে মাটির গুণগত মান দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে এবং কার্বন শোষণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাবও বাড়ছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে সেচব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদন খরচ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাতের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ধানের ফলনও কমে যাচ্ছে—যা ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর এ বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এখনই জরুরি ভিত্তিতে অভিযোজনমূলক প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বৈশ্বিক ঐকমত্য ও সহযোগিতাই পারে এই সংকট থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে।