জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রকৃতির সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায় হলো গাছ লাগানো। গাছ শুধু পরিবেশকে শীতল রাখে না, বরং বাতাস বিশুদ্ধ করে, ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় গাছই হতে পারে সবচেয়ে টেকসই সমাধান।
বাংলাদেশের বনভূমি: হ্রাসের ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২০ শতাংশ ছিল বনভূমি— প্রায় ২.৭ থেকে ২.৮ মিলিয়ন হেক্টর। তখন সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মধুপুর গড় এবং সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় ছিল।
তবে স্বাধীনতার পর দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমির সম্প্রসারণ, দখল ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বনভূমি ক্রমেই উজাড় হতে থাকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) Global Forest Resources Assessment অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে দেশের মোট ভূমির ১৭.৬ শতাংশ ছিল বনভূমি, যা ২০২০ সালে নেমে আসে ১৪.৫ শতাংশে। ২০২৫ সালে এই হার আরও কমে প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ পরিসংখ্যান আমাদের সতর্ক করছে— এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ুর ওপর এর প্রভাব ভয়াবহ হবে।
রোহিঙ্গা আগমনে বনভূমির ক্ষয়
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরণার্থী শিবির গঠনের জন্য লাখ লাখ গাছ কেটে ফেলা হয়।
আইইউসিএন (IUCN)-এর ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এই অঞ্চলের সবুজ আচ্ছাদন প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যায়।
এর ফলে শুধু বনজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য নয়, বরং ভূমিক্ষয়, পাহাড়ধস, জলাবদ্ধতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো সমস্যা বেড়ে যায়।
স্থানীয়দের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়— কাঠ, বাঁশ, জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদ হারানোর পাশাপাশি স্থানীয় ও শরণার্থীদের মধ্যে সম্পদসংকটজনিত উত্তেজনাও বৃদ্ধি পায়।
গাছ—প্রকৃতির প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা
গাছ কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করে তা নিজেদের কাঠ, পাতা ও শিকড়ে সংরক্ষণ করে রাখে—এই প্রক্রিয়াকে বলে কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন। ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব কমে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
গাছ ছায়া প্রদান ও জলীয় বাষ্প নিঃসরণের মাধ্যমে পরিবেশকে শীতল রাখে এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখে। ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
একই সঙ্গে বনজ পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে— যা খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও টেকসই জীবিকার জন্য অপরিহার্য।
উপকূলীয় এলাকায় লবণসহনশীল গাছের গুরুত্ব
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল— যেমন সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলার কিছু অংশ— এখন জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক অভিঘাতের মুখে। লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস, মাটির ক্ষয় ও খরার কারণে এসব অঞ্চলের পরিবেশ ও কৃষি উভয়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
তাই এই অঞ্চলে লবণ ও ঝড় সহনশীল গাছ রোপণ করা জরুরি।
-
বাইন: উপকূলীয় এলাকায় সবচেয়ে উপযোগী ম্যানগ্রোভ প্রজাতি। এটি লবণাক্ত পানিতে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে ও জলোচ্ছ্বাস রোধে প্রাকৃতিক বাঁধের কাজ করে।
-
গেওয়া: নদীতীর ও বাঁধ সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর, সহজে লবণাক্ত পরিবেশে অভিযোজিত হয়।
-
গরান: দ্রুতবর্ধনশীল ও লবণসহনশীল গাছ, যা চরাঞ্চল ও জলমগ্ন এলাকায় ভূমি সংরক্ষণে সহায়ক।
-
সোনালু, হিজল, করচ: মাঝারি লবণসহনশীল গাছ, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, রাস্তার ধারে বা খালপাড়ে লাগানোর উপযোগী।
-
নিম, বাবলা, কাঁঠাল, নারকেল ও সুপারি: ফলদ ও কাঠজাত গাছ হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, তবে লবণসহনশীল জাত বেছে নেওয়া জরুরি।
-
বাঁশ: দ্রুতবর্ধনশীল, ঝড় সহনশীল এবং ভূমিক্ষয় রোধে কার্যকর।
গাছ লাগানোর সঠিক সময় ও কৌশল
বাংলাদেশে গাছ লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস (জুন–আগস্ট)। বর্ষাকালে বৃষ্টি বেশি হয়, ফলে মাটি আর্দ্র থাকে এবং চারার শিকড় সহজে বসে যায়।
তাছাড়া মেঘলা আবহাওয়ায় সূর্যের তাপ কম থাকায় চারা পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কমে।
তবে কিছু গাছ— যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু— বসন্তকালে (ফেব্রুয়ারি–মার্চ) রোপণ করা উত্তম। অনাবৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় সেচের ব্যবস্থা রাখলে সফলভাবে চারা রোপণ করা যায়।
রোপণের সময় উঁচু জায়গায় মাটি তুলে চারা লাগানো, জলাবদ্ধতা এড়ানোর ব্যবস্থা রাখা এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে কমিউনিটি বনায়ন চালু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিন দিন ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। তাই বন সংরক্ষণ ও নতুন গাছ লাগানো আর কোনো বিলাসিতা নয়—এটি এখন টিকে থাকার শর্ত।
আসুন, আমরা সবাই এ বর্ষায় অন্তত একটি করে গাছ লাগাই— নিজের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, পৃথিবীর জন্য।