জলবায়ু পরিবর্তন এখন বৈশ্বিকভাবে আলোচিত ও উদ্বেগজনক একটি বিষয়। তবে এর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে উন্নয়নশীল ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর। তার অন্যতম উদাহরণ বাংলাদেশ।
ভৌগোলিক অবস্থান, ঘনবসতি, দারিদ্র্য, দুর্বল অবকাঠামো ও নদীনির্ভর জীবনের কারণে দেশটি আজ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বড় ভুক্তভোগী।
বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান নগণ্য—মাত্র শূন্য দশমিক এক শতাংশেরও কম। তবু এর পরিণতি ভোগ করছে দেশের কোটি মানুষ।
বিজ্ঞানীদের মতে, গড় তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বাড়ছে। পরিবর্তিত আবহাওয়ায় খরা, অনাবৃষ্টি ও অস্বাভাবিক বন্যা এখন স্বাভাবিক ঘটনা।
খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার উপকূলীয় অঞ্চল এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম সারির শিকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেড়েছে লবণাক্ততা, ক্ষয় হচ্ছে কৃষিজমি ও বসতি।
স্থানীয়রা বলছেন, আগে যেখানে এক ফসল হতো, এখন চাষই অসম্ভব। ফলে অনেক পরিবার পেশা বদলে শহরমুখী হচ্ছে— সৃষ্টি হচ্ছে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ নামের নতুন মানবিক সংকট।
এক সময়ের সময়নিষ্ঠ মৌসুমি বৃষ্টি এখন অনিশ্চিত। কখনো অতিবৃষ্টি, কখনো খরা—ফলে ধান, পাট, আলু, গমসহ বহু ফসল ক্ষতিগ্রস্ত।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তাকে বড় হুমকির মুখে ফেলবে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির সংকট ও দূষণের কারণে দেশে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, হিটস্ট্রোক ও শ্বাসতন্ত্রের রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরাঞ্চলে গরমের তীব্রতা ও দূষণের প্রভাবে বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
‘সিডর’ (২০০৭), ‘আইলা’ (২০০৯), ‘আম্পান’ (২০২০) ও সাম্প্রতিক ‘রেমাল’—প্রতিটি ঝড়ে উপকূলীয় জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের তুলনায় এখন ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে। এ দুর্যোগ শুধু প্রাণহানি ঘটাচ্ছে না, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও কৃষি ব্যবস্থাকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট, রোগবালাই ও উৎপাদন কমে গেছে।
পশুপালন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার মতে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও ঘূর্ণিঝড়ে ঘাসের মাঠ নষ্ট হচ্ছে, ফলে দুধ উৎপাদন ও প্রজনন হার হ্রাস পেয়েছে।
খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে— কমে গেছে প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার ইতিমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০৯ সালে গৃহীত ‘Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)’–এর আওতায় চলছে উপকূলীয় বাঁধ পুনর্নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার সম্প্রসারণ, লবণসহিষ্ণু ধান উদ্ভাবন ও সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ প্রকল্প।
এছাড়া ‘Bangladesh Climate Change Trust Fund’ গঠন এবং ‘Mujib Climate Prosperity Plan 2041’–এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন পরিকল্পনায় অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “বাংলাদেশ এখন আর কেবল ক্ষতিগ্রস্ত নয়, বরং অভিযোজন ও পুনরুদ্ধার–উদ্যোগের বৈশ্বিক উদাহরণ।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন সময় এসেছে দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন পরিকল্পনা ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর।
তাদের পরামর্শে কয়েকটি প্রধান পদক্ষেপ—
* নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহ ও জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প উন্নয়ন
* বনায়ন ও সবুজ অঞ্চল রক্ষা
* স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা
* লবণসহিষ্ণু ফসল, ভাসমান চাষাবাদ ও পানি সংরক্ষণের প্রযুক্তি সম্প্রসারণ
* জলবায়ু তহবিলে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ইতিমধ্যেই ভাসমান কৃষি ও বিকল্প জীবিকা উদ্যোগ আশার বার্তা দিচ্ছে। স্থানীয় কৃষকেরা পানির ওপর ভাসমান বেডে সবজি চাষ করছেন, যা জলাবদ্ধ ও লবণাক্ত জমিতেও টেকসই ফলন দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের উদ্ভাবনই ভবিষ্যতের অভিযোজন মডেল হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশ নয়—এটি মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটও বটে।
বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কারণ, এই পৃথিবী শুধু আমাদের নয়—আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরও।