দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেমে বদলির পর এবার চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
  • আপডেট : ০৭:৩৯:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • / 235
আলোচিত দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলির পর এবার চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই চট্টগ্রামের সাবেক আলোচিত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করে দিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কক্সবাজার ও কর্ণফুলী গ্যাসের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। পরে তাকে হঠাৎ চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। মূলত প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েই তাকে গণ-বদলির সিরিয়ালে ফেলে কৌশলে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে আলোচনা আছে।

এখন কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই আলোচিত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করে দিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শরীফ উদ্দিন বর্তমানে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, পটুয়াখালীতে উপসহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মাত্র দুই বছরে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের-২ উপ-সহকারী পরিচালক থাকা অবস্থায় মো.শরীফ উদ্দিন অনেকগুলো অবিশ্বাস্য দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করেছেন। তার তদন্তে উঠে এসেছে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার দুর্নীতিবাজদের চমকজাগানো সব তথ্যপ্রমাণ।

বুধবার দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

আদেশে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দীন, উপ-সহকারী পরিচালক, দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’ আদেশটি আজ থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

দুদকের চাকরি বিধিমালা ৫৪ এর ২ ধারায় বলা আছে— ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোন কারণ না দর্শাইয়া কোন কর্মচারিকে নব্বই দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা নব্বই দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’

এর আগে, গত বছর ১৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে মো. শরীফ উদ্দিনসহ আরও ২১ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছিল দুদকের বিভিন্ন ইউনিটে। তখন শরীফকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল।

তখন তার এ বদলিকে স্বাভাবিক চোখে দেখেননি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলকারী সংগঠকরা। কেননা গত দুই বছরে তার বিছানো জালে আটকা পড়তে হয়েছে সরকারি বড় কর্তা থেকে ছোট কর্মচারী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ থেকে পাড়ার পাতি নেতাকেও। পুরো চট্টগ্রামজুড়ে চষে বেড়িয়েছেন আর একের পর এক চমক লাগানো সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে কুড়িয়েছেন প্রশংসা।

জানা যায়, শরীফ উদ্দীন ২০২১ সালের ১৬ জুন হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অর্ন্তভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর আগে, গত ১৫ জুন রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জন এবং ১২ জুন ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ।

তবে ১০ জুন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামের (বিএসসি) বড় ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দীন। এ মামলায় মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করে দুদক। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

এছাড়া তার আরও বেশ কয়েকটি আলোচিত অভিযান ছিল। তারমধ্যে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স (পিবিআই) অফিস তৈরির জন্য এক একর (১০০ শতক) জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে দুদকের এ কর্মকর্তার তদন্তে। এ ঘটনাসহ কক্সবাজারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতিতে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়।

২০২১ সালের ৩১ মার্চ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে খালাসি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে রেলওয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমদসহ ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এতে অভিযোগ আনা হয়, ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগকালে নিয়োগ কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুইজন সদস্যের ইন্ডিভিজুয়াল মার্কশিট না থাকা, কম্বাইন্ড মার্কশিটে ৪ জনের নম্বর দেখানো হলেও একজনের মূল্যায়ন মার্ক অসৎ উদ্দেশ্যে সৃজন করে প্রতারণাপূর্বক ১৯ জনকে নিয়োগ প্রদান, দুইজন নিয়োগ প্রার্থীকে চার জেলা থেকে নিয়োগ, বয়স্ক ও জাল সনদধারী লোকদের জাল সনদ সৃজনপূর্বক ব্যবহার করে চাকরি প্রদান করার অসৎ উদ্দেশ্যে নিজেরা লাভবান হয়ে বা অন্যকে অন্যায় লাভে লাভবান করে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ সম্পৃক্ত অপরাধ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা গ্রহণ করে ভোগ দখল ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করেছেন।

এছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে দাখিল করার পর গত ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের চট্টগ্রামের খুলশীর ভাড়া বাসায় নিচে এসে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেন কেজিডিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং পেট্রোবাংলা পরিকল্পনা ও পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরী এবং কেজিডিসিএলের আরেক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মোরশেদ উল্লাহ। দারোয়ানের উপস্থিতিতে আইয়ুব খান চৌধুরী এ সময় বলেন, শরীফ উদ্দিনের কারণে তার জীবন ধ্বংস হয়েছে। তিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নিউজ করিয়েছেন। দুদকে কিভাবে চাকরি করেন দেখে নেবেন আইয়ুব খান। চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে তার মতো অনেকের জীবন ধ্বংস করেছেন শরীফ উদ্দিন। ওইদিনের হুমকির ১৬ দিনের মাথায় চাকরি হারালেন দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন।

৩০ জানুয়ারি রাতে হত্যার অভিযোগ এনে মো. শরীফ উদ্দিন সিসি টিভির ফুটেজসহ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডির অভিযোগে বলা হয়, দুই সন্তানসহ পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন খুলশী এলাকার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন এই দুদক কর্মকর্তা।

গত ৩০ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন দিনের ছুটিতে পটুয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের বাসায় এলে ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরীসহ আরও একজন বাসার নিচে এসে সরাসরি হুমকি দেন ও অশোভন আচরণ করেন। সেসময় ওই বাসায় নিরাপত্তা কর্মী উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন জানান, কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়ায় আমাকে হঠাৎ চাকরিচ্যুত করে। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়। এভাবে হঠাৎ করে চাকরি থেকে অপসারণ করে আমার প্রতি কমিশন অবিচার করেছে। আমি কখনও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করিনি বলে আজ আমার এই পরিণতি। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচার চাই।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেমে বদলির পর এবার চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা

আপডেট : ০৭:৩৯:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২
আলোচিত দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলির পর এবার চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই চট্টগ্রামের সাবেক আলোচিত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করে দিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কক্সবাজার ও কর্ণফুলী গ্যাসের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। পরে তাকে হঠাৎ চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। মূলত প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েই তাকে গণ-বদলির সিরিয়ালে ফেলে কৌশলে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে আলোচনা আছে।

এখন কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই আলোচিত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করে দিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শরীফ উদ্দিন বর্তমানে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, পটুয়াখালীতে উপসহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মাত্র দুই বছরে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের-২ উপ-সহকারী পরিচালক থাকা অবস্থায় মো.শরীফ উদ্দিন অনেকগুলো অবিশ্বাস্য দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করেছেন। তার তদন্তে উঠে এসেছে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার দুর্নীতিবাজদের চমকজাগানো সব তথ্যপ্রমাণ।

বুধবার দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

আদেশে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দীন, উপ-সহকারী পরিচালক, দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’ আদেশটি আজ থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

দুদকের চাকরি বিধিমালা ৫৪ এর ২ ধারায় বলা আছে— ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোন কারণ না দর্শাইয়া কোন কর্মচারিকে নব্বই দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা নব্বই দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’

এর আগে, গত বছর ১৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে মো. শরীফ উদ্দিনসহ আরও ২১ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছিল দুদকের বিভিন্ন ইউনিটে। তখন শরীফকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল।

তখন তার এ বদলিকে স্বাভাবিক চোখে দেখেননি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলকারী সংগঠকরা। কেননা গত দুই বছরে তার বিছানো জালে আটকা পড়তে হয়েছে সরকারি বড় কর্তা থেকে ছোট কর্মচারী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ থেকে পাড়ার পাতি নেতাকেও। পুরো চট্টগ্রামজুড়ে চষে বেড়িয়েছেন আর একের পর এক চমক লাগানো সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে কুড়িয়েছেন প্রশংসা।

জানা যায়, শরীফ উদ্দীন ২০২১ সালের ১৬ জুন হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অর্ন্তভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর আগে, গত ১৫ জুন রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জন এবং ১২ জুন ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ।

তবে ১০ জুন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামের (বিএসসি) বড় ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দীন। এ মামলায় মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করে দুদক। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

এছাড়া তার আরও বেশ কয়েকটি আলোচিত অভিযান ছিল। তারমধ্যে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স (পিবিআই) অফিস তৈরির জন্য এক একর (১০০ শতক) জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে দুদকের এ কর্মকর্তার তদন্তে। এ ঘটনাসহ কক্সবাজারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতিতে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়।

২০২১ সালের ৩১ মার্চ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে খালাসি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে রেলওয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমদসহ ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এতে অভিযোগ আনা হয়, ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগকালে নিয়োগ কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুইজন সদস্যের ইন্ডিভিজুয়াল মার্কশিট না থাকা, কম্বাইন্ড মার্কশিটে ৪ জনের নম্বর দেখানো হলেও একজনের মূল্যায়ন মার্ক অসৎ উদ্দেশ্যে সৃজন করে প্রতারণাপূর্বক ১৯ জনকে নিয়োগ প্রদান, দুইজন নিয়োগ প্রার্থীকে চার জেলা থেকে নিয়োগ, বয়স্ক ও জাল সনদধারী লোকদের জাল সনদ সৃজনপূর্বক ব্যবহার করে চাকরি প্রদান করার অসৎ উদ্দেশ্যে নিজেরা লাভবান হয়ে বা অন্যকে অন্যায় লাভে লাভবান করে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ সম্পৃক্ত অপরাধ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা গ্রহণ করে ভোগ দখল ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করেছেন।

এছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে দাখিল করার পর গত ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের চট্টগ্রামের খুলশীর ভাড়া বাসায় নিচে এসে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেন কেজিডিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং পেট্রোবাংলা পরিকল্পনা ও পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরী এবং কেজিডিসিএলের আরেক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মোরশেদ উল্লাহ। দারোয়ানের উপস্থিতিতে আইয়ুব খান চৌধুরী এ সময় বলেন, শরীফ উদ্দিনের কারণে তার জীবন ধ্বংস হয়েছে। তিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নিউজ করিয়েছেন। দুদকে কিভাবে চাকরি করেন দেখে নেবেন আইয়ুব খান। চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে তার মতো অনেকের জীবন ধ্বংস করেছেন শরীফ উদ্দিন। ওইদিনের হুমকির ১৬ দিনের মাথায় চাকরি হারালেন দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন।

৩০ জানুয়ারি রাতে হত্যার অভিযোগ এনে মো. শরীফ উদ্দিন সিসি টিভির ফুটেজসহ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডির অভিযোগে বলা হয়, দুই সন্তানসহ পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন খুলশী এলাকার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন এই দুদক কর্মকর্তা।

গত ৩০ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন দিনের ছুটিতে পটুয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের বাসায় এলে ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরীসহ আরও একজন বাসার নিচে এসে সরাসরি হুমকি দেন ও অশোভন আচরণ করেন। সেসময় ওই বাসায় নিরাপত্তা কর্মী উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন জানান, কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়ায় আমাকে হঠাৎ চাকরিচ্যুত করে। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়। এভাবে হঠাৎ করে চাকরি থেকে অপসারণ করে আমার প্রতি কমিশন অবিচার করেছে। আমি কখনও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করিনি বলে আজ আমার এই পরিণতি। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচার চাই।