তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগের প্রেক্ষিতে কোম্পানীর অপকৌশল
- আপডেট : ০৪:১১:৪৮ অপরাহ্ন, সোমাবার, ৮ অগাস্ট ২০২২
- / 342
তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ক্ষতিকর পণ্য। এটি নিয়ে বিতর্ক করার অবকাশ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া’র ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যখনই কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়; তখনই তামাক কোম্পানী’র গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। সরকার ও নীতিনির্ধারকদেরকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার জন্য নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়।
তার মধ্যে একটি অন্যতম প্রচেষ্টা থাকে গণমাধ্যমে তাদের অনুগত কিছু সংখ্যক সংবাদ কর্মী ও বুদ্ধিজীবিদের দিয়ে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করা। এর মাধ্যমে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ ও পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নেতিবাচক জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করে।
আইন সংশোধনী প্রস্তাবনাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে তারা জোরেসোরে কয়েকটি বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। এর মধ্যে একটি, স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ না করে মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। এই বাদ পড়া স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে তামাক কোম্পানী ও তাদের মদদপুষ্ট তথাকথিত তামাক বিরোধী সংগঠন।
তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষার সাথে সম্পর্কিত। জনস্বাস্থ্যকে রক্ষার স্বার্থেই দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রণয়ন হয়েছে এবং সময়ের দাবীতে সেটা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। তামাক কোম্পানী একইরকমভাবে প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ।
সেক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং তামাক কোম্পানীর ব্যবহারিক অবস্থান একে অপরের বিপরীতে। উভয়ের স্বার্থ রক্ষাও বিপরীতমুখী। সেখানে কোন যুক্তিবলে তামাক কোম্পানী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবনায় স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবে?? তাদের স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবার নুন্যতম কোন যৌক্তিক কারণ নেই। অন্তত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোন উদ্যোগের সাথে।
ব্যাপারটি অনেকটা এমন, চুরি প্রতিরোধে মহল্লায় সভা আহ্বান করা হয়েছে। সেই সভায় মহল্লার সবাই উপস্থিত, মহল্লায় বসবাসকারী চোরও উপস্থিত। সবাই চুরি প্রতিরোধের জন্য নানা পরিকল্পনা উপস্থাপন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায় চুড়ান্ত। তখন সভায় উপস্থিত চোরের প্রতিনিধি গলা উচু করে বলছে, ‘আপনারা তো সব পথই বন্ধ করে ফেলছেন, একটা পথ তো খুলে রাখুন যাতে আমরা চুরি করাটা অব্যহত রাখতে পারি।’
তামাক কোম্পানীর আব্দারটাও আইন সংশোধনীর ক্ষেত্রে এমন; ওনাদেরকে স্টেকহোল্ডার বিবেচনায় নিয়ে কথা শুনতে হবে। তারা প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনীর বিভিন্ন ধারা বিরোধিতা করে প্রস্তাবনা দেওয়ার সুযোগ চায়। যাতে জনস্বাস্থ্য ক্ষতি করার জন্য তাদের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়, তাদের জনস্বাস্থ্য ক্ষতির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেটা বাধাগ্রস্থ না হয়!!
কী চমৎকার আব্দার তামাক কোম্পানীর!! এই আব্দারকে ন্যায্যতা দেবার জন্য একপক্ষ নির্লজ্জভাবে তামাক কোম্পানীর পক্ষে কাজ করছে দেশের জনস্বাস্থ্যকে হুমকীর মধ্যে ফেলে দিয়ে। এটা তামাক কোম্পানীর চরম দুঃসাহস। এভাবেই তারা প্রতিনিয়তো এফসিটিসি’র আর্টিক্যাল ৫.৩ ভঙ্গ করে তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজের জন্য তারা কিছু অনুগত সঙ্গী-সাথীও জোগাড় করেছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র Guidelines for implementation of Article 5.3 এ বলা হয়েছে, ‘The purpose of these guidelines is to ensure that efforts to protect tobacco control from commercial and other vested interests of the tobacco industry are comprehensive and effective. Parties should implement measures in all branches of government that may have an interest in, or the capacity to, affect public health policies with respect to tobacco control (decision FCTC/COP3(7))’.
বাংলাদেশ এফসিটিসি’তে অনুস্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। সেই অবস্থান থেকে উল্লেখিত গাইডলাইন অনুসারে, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অথবা তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য যেকোন ধরনের কৌশলপত্র নির্ধারণে তামাক কোম্পানীর মতামত দেবার নুন্যতম কোন সুযোগ নেই। তাদের মতামত গ্রহণ করা অর্থ, এফসিটিসি’র আর্টিক্যাল ৫.৩ এর ধারা ভঙ্গ করা। সঙ্গত কারণেই আমাদের সরকার সেটা করতে পারেনা।
অন্যদিকে তামাক কোম্পানীর স্বার্থরক্ষাকারী তথাকথিত তামাক বিরোধী কতিপয় সংগঠন কোম্পানীর সাথে সুর মিলিয়ে প্রস্তাবিত আইন সংশোধনকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য অযৌক্তিক বিতর্ক উপস্থাপন করছে। তামাক কোম্পানীর পয়সায় লালিত-পালিত এই সমস্ত সংগঠন তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা বলে মূলত তামাক কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষা করে। এমন শুধু বাংলাদেশেই নয়; সারাবিশ্বব্যাপী কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং প্রকৃতঅর্থে যারা তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে তাদের কাজকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য এধরনের সংগঠনের জন্ম তামাক কোম্পানীই দিয়ে থাকে।
সংশোধিত আইনের খসড়া প্রস্তাবনায় লাইসেন্সিং ব্যবস্থা অন্তর্ভূক্ত হওয়াতে কোম্পানীর গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। এটা নতুন বিষয় নয়। ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’তে লাইসেন্সিং ব্যবস্থাটি যখন যুক্ত করা হয় তখনই তাদের অপতৎপরতা শুরু হয় এটা বাতিলের জন্য।
তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম লক্ষ্য এর সহজপ্রাপ্যতা হ্রাস করা। তার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার কমিয়ে আনা। লাইসেন্সিং ব্যবস্থা এই উদ্দেশ্য পূরণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে সেটি ইতিমধ্যে প্রমাণীত। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হতে তামাক বিক্রেতারা লাইসেন্স গ্রহণ করে ব্যবসা করছে। খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ মানিকগঞ্জ, সিঙ্গাইর এর মতো বিভিন্ন পৌরসভা শুরু করেছে গত অর্থবছর থেকেই।
যারা লাইসেন্স গ্রহণ করেছে তারাই বৈধভাবে ব্যবসা করছে। একটি সংবাদপত্রে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি’র সভাপতির মন্তব্য তুলে ধরেছে এই বিষয়ে। তিনি বলছেন,‘কেরোসিন বা স্যালাইন বিক্রি করতে যদি পৃথক লাইসেন্স নিতে না হয় তাহলে তামাক বিক্রির জন্য আলাদা লাইসেন্স কেনো নিতে হবে?’
আপনারাই বলুন, কেরোসিন বা স্যালাইন কী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? সরকার কী এমন কোন পরিকল্পনা করেছে যে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্যালাইন আর কেরোসিন মুক্ত করবে? না, এমন কোন ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করবে এই ঘোষণা বর্তমান সরকার প্রধান দিয়েছেন। আর সেটি বাস্তবায়নের জন্য এর ব্যবহার কমিয়ে আনা আবশ্যক। আর সেটার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ লাইন্সেসিং ব্যবস্থা।
প্রচার করা হচ্ছে, ১৫ লাখ নি¤œ আয়ের খুচরা বিক্রেতা আছে। এই তথ্যের কোন সঠিকতা নেই। বলা হচ্ছে, লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর হলে এদের জীবন-জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে। কী হাস্যকর যুক্তি! এদের বক্তব্য অনুসারে মনে হয়, বাংলাদেশে ফেরি করে বিক্রি করার একমাত্র পণ্য সিগারেট। এটা ব্যতীত ফেরি করে অন্য কোন পণ্য বিক্রি করে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেনা!! লাইসেন্সিং ব্যবস্থা গত একবছর ধরে চলমান। যারা দ্বৈত লাইসেন্স গ্রহণ না করে তামাক বিক্রি করা ছেড়ে দিয়েছে তাদের কারো জীবন-জীবিকাই বন্ধ হয়ে যায়নি। যেটা হয়েছে সেটা হলো ঐ এলাকাগুলিতে সিগারেট বিক্রি কমে গেছে।
আরে ভাই, সরকারের লক্ষ্যই তো তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি কমিয়ে আনা। সেজন্যই তো আইন করে এই বিক্রিকে কঠিন করে আনা হচ্ছে যাতে সিগারেট বা অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত বোধ করে। সিগারেটের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রি করা শুরু করে। তার জন্য তো আর পৃথক লাইসেন্স নেওয়ার কথা বলেনি সরকার।
একটি বহুল প্রচলিত সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার এই খাত থেকে। কিন্তু এটা বলা হলো না, এই ৩০ হাজার কোটি টাকা আয় করতে যেয়ে তামাক ব্যবহারের আর্থিক ক্ষতি বাবদ ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে!!
তামাক নিয়ন্ত্রণে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধীত ২০১৩) এর সংশোধনী এখন সময়ের দাবী। সেই দাবী’র প্রতি সাড়া দিয়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুনভাবে আইনে যেসকল সংশোধনী প্রস্তাবনা যুক্ত করেছে তা অত্যন্ত যুগোপযোগী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ইতিমধ্যে এই ধারাগুলি সংযুক্ত হয়েছে। এবং তারা এর সুফল পাচ্ছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের লক্ষ্য তামাক কোম্পানীর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা না; জনস্বাস্থ্যকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা। আর তামাক কোম্পানীর লক্ষ্য তামাজাত দ্রব্যের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা; চুড়ান্তভাবে যা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।
তামাক কোম্পানী তার অনুগতদের দিয়ে আইনের সংশোধন বিষয়ে যে নেতিবাচ প্রচারণা চালাচ্ছে তার উদ্দেশ্যই হলো আইনের নতুন ধারাগুলি যাতে যুক্ত না হয়। কারণ এই ধারাগুলি যুক্ত হলে তামাক কোম্পানীর বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। লাইসেন্সিং ধারাটি তার মধ্যে অন্যতম। সেকারণে এই বিষয়টি নিয়ে তাদের বিরোধীতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
আমাদের আগামী প্রজন্মকে তামাকের সর্বনাশা ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের নাগরিক দায়িত্ব তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর প্রস্তাবনাকে সমর্থন করা এবং তামাক কোম্পানীর কূটকৌশলকে প্রহিত করা।