শনিবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু পরিবর্তন : কৃষি ও জেলে পেশায় ভয়াবহ সংকট, জীবিকা হারাচ্ছে মানুষ

আব্দুল মতিন
জুলাই ২০, ২০২৫ ৫:০৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

পটুয়াখালীর উপকূলীয় উপজেলা কলাপাড়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কৃষি ও জেলে পেশায় নেমে এসেছে ভয়াবহ সংকট। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অস্বাভাবিক জোয়ারে বিলীন হচ্ছে গ্রাম, জমি ও জীবিকা— ভাঙছে মানুষের বেঁচে থাকার ভিত্তি।

রাবনাবাদ নদীর তীরে এক সময়ের প্রাণচঞ্চল চৌধুরীপাড়া এখন মানচিত্রেই শুধু। নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে সব। সেই গ্রামের সুখী বেগম এখন মহল্লাপাড়া গ্রামে আশ্রিত। তিনবার ঠিকানা বদলেছেন, সিডর ও আইলায় ভেঙে গেছে ঘরবাড়ি। ঢাকায় ইটভাঙার শ্রমিক হয়ে জমি কিনে ঘর তুলেছিলেন, সেটিও এখন জীর্ণ।
স্ট্রোকে পঙ্গু সুখী বেগম বলেন, “সব শেষ হয়ে গেছে। এখন ওষুধ কেনারও টাকা নেই।”

তার স্বামী দুলাল গাজী জানান, আগে ভাগে ট্রলারের কাজে ছিলেন, এখন ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ছেলেকে নিয়ে সাগরে যান। কিন্তু মাছ নেই, রাবনাবাদের রোষে জীবন প্রায় থেমে গেছে।

কুয়াকাটার অগভীর সাগরে খুটা জেলে আবু হানিফ মাঝি বলেন, “এ বছর সাগরে মাছের দেখা নাই। ঢেউয়ে জাল ছিঁড়ে গেছে, লাখ টাকার ক্ষতি।”
জেলেদের দাবি, গত চার বছর ধরেই ইলিশের আকাল চলছে। এবছর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

একেক জেলের ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকার জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় আড়াই শ’ নৌকার জেলেরা অর্ধকোটি টাকার ক্ষতির মুখে। দাদনের টাকায় কেনা জাল-ইঞ্জিনের কিস্তি দিতে পারছেন না অনেকে।

‘আশার আলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’র সভাপতি নিজাম শেখ জানান, কুয়াকাটার উপকূলে প্রায় ৪৬০টি খুটা জেলে নৌকায় দেড়-দুই হাজার পরিবার ইলিশ শিকার করে বাঁচে। শতকরা ৯০ ভাগ জেলের জাল এবারে ছিঁড়ে গেছে। তিনি বলেন, “আমরা জলবায়ু বুঝি না, বুঝি দুর্যোগ চলছে।”

কুমিরমারা গ্রামের ৯৫ শতাংশ কৃষক ধান ও সবজি চাষে নির্ভরশীল। কৃষক সুলতান গাজী জানালেন, “আগে ফি বছর ৭–৮ টন করলা বিক্রি করতাম। এবার আটদিনের বৃষ্টিতে ৭৫ ভাগ ফসল নষ্ট।”
তিনি আরও বলেন, “ভোরে গরম, সন্ধ্যায় ঠান্ডা, কখনো বৃষ্টি কখনো রোদ— এমন আবহাওয়া আগে দেখি নাই।”

আবহাওয়ার এই চরম ওঠানামায় আমন বীজতলাও পচে গেছে। কৃষকদের ভাষায়, “জলবায়ু এখন দুর্যোগ হয়ে উঠেছে।”

২০০৭ সালের সিডর থেকে সাম্প্রতিক রেমাল পর্যন্ত উপকূলীয় এই অঞ্চলে ১৫টি বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছে। বেড়িবাঁধের বাইরের প্রায় ৬ হাজার পরিবার বর্ষাকালে মাসের অর্ধেক সময় জোয়ারে ভাসে।
লোন্দা বেড়িবাঁধের বাইরের বাসিন্দা হালিমা আয়শা বলেন, “এবারের মতো এত পানি আগে দেখি নাই। অমাবস্যায় রান্নাও বন্ধ রাখতে হয়, চুলো পর্যন্ত ডুবে যায়।”

কলাপাড়া ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, শুধু সতর্ক সংকেতের কারণেই ২০২১ সালে ১১৭ দিন, ২০২২ সালে ১১০ দিন এবং ২০২৩ সালে ১১৩ দিন মাছ ধরা বন্ধ ছিল।
এ বছর নিষেধাজ্ঞার বাইরে আরও ২০ দিন সাগর উত্তাল থাকায় ট্রলার ঘাটে বন্দি ছিল। মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি রাজু আহমেদ রাজা বলেন, “এবার সাগর অচেনা লাগছে, ঢেউয়ে সৈকতের গাছপালাও লন্ডভন্ড।”

উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়মিত সভা করলেও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয়। সদস্যরা অনেকেই জানেন না তাদের দায়িত্ব কী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পনা ও বাজেট ঘাটতি, নারী নেতৃত্বের অভাব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিই এর মূল কারণ।

ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান জানান, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় তারা ৮টি ইউনিয়নে সচেতনতামূলক সভা, প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা সভা করেছেন।
‘আমরা কলাপাড়াবাসী’ সংগঠনের সভাপতি নাজমুস সাকিব বলেন, “খাল–নদী রক্ষা, প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ ও বৃক্ষরোপণ ছাড়া কলাপাড়াকে বাঁচানো সম্ভব নয়।”

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন জানান, লবণসহিষ্ণু ফসল ও নতুন জাতের সবজি চাষে সহায়তা কার্যক্রম চলছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইয়াসীন সাদেক বলেন, “কলাপাড়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলেও আমরা সফলভাবে বড় বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি। আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসন ও বিকল্প পেশায় জেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।”

উপকূলের মানুষ জানে না জলবায়ু পরিবর্তন কী, কিন্তু প্রতিদিন তার ক্ষতই তারা বহন করছে।
ভাঙা বাঁধ, হারানো ফসল ও ছেঁড়া জালের মধ্যে টিকে থাকার লড়াইয়ে আজও তারা বেঁচে আছে — ভবিষ্যতের ভয় নিয়েই।