ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পার হলেও সরকারি বিভিন্ন দফতরে অস্থিরতা কাটেনি। কোথাও রাজনৈতিক ভোলপাল্টে আগের মতোই দাপট দেখাচ্ছেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোথাও আবার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তটস্থ থাকলেও কৌশলে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরে চলছে বদলির খেলা।
কিছুদিন পরপরই একযোগে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা হচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার ও তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সংবাদ প্রকাশের পর বদলিতে গতি বেড়েছে বলে জানা গেছে। কারণ ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করার পাশাপাশি গণপূর্তের ‘পীর- মুরিদ’ চক্রের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করেছে সরকার।
এদিকে গোয়েন্দাসংস্থা নজর দিতে শুরু করেছে গণপূর্তে অধিদপ্তরে। অনেকের নাম আসতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ‘যমুনা হাউজে’ প্রবেশে দিচ্ছেন নিষেধাজ্ঞা। এখন এসব প্রকৌশলীরা রয়েছেন ব্যাপক আলোচনায় তারা হলেন- নিবার্হী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান (সিভিল), নিবার্হী প্রকৌশলী (ই/এম) রাজু আহমেদ, এসি টেকনিশিয়ান মো. মাহিম, বিটিসিএল লাইনম্যান মো. শহিদুল ইসলাম। তারা বিগত সরকারের আমলে ব্যাপক অনিয়ম করেছেন।
কে এই মাহবুবুর রহমান : গণপূর্ত অধিদপ্তরে তিনি ডিপ্লোমা মাহাবুব নামে পরিচিত। কিন্তু কাজে তাঁর পেছনে ছোটেন গণপূর্তের চলতি দায়িত্বে প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারও। আলাদিনের যাদুর মতো হঠাৎই প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পাওয়া শামীম একদমই দেখতে পারতেনা এই মাহাবুবকে। ডাকতো ‘ডিপ্লোমা’ বলে। পাবলিক লাইব্রেরী, হাইকোর্টসহ কয়েকটি কাজের টেন্ডার শামীম আখতারের পছন্দের লোককে দিয়ে তিনিই এখন প্রিয়জন হয়ে উঠেছেন এই শামীমের।
জানা গেছে, এই নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুবুর রহমান এসএসসি পাসের পর পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন। পরে ডুয়েট থেকে বিএসসি পাস করে ২১তম বিসিএস-এ যোগ দেয়। যোগদানের পর থেকে নানা অপকর্মের এই হোতা মাহাবুব বেশিরভাগ সময়ই ঢাকাতে চাকুরি করছেন। উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর গণপূর্ত বিভাগ, নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ, মেডিকেল গণপূর্ত বিভাগ এবং এই মুহুর্তে এলাকার বিচারে সবচেয়ে বড় ডিভিশন-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার গুরুত্ব নগর গণপূর্ত বিভাগ (সিটি ডিভিশন) দায়িত্বে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্তের একাধিক প্রকৌশলী এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে তারা অনেক দুর্নীতি-অনিয়ম করেছেন। নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এদের ক্ষমতার উৎস কি? তা ভবনের সবারই অজানা নয়। আমরা চাই দুর্নীতি করে যত সম্পদ অর্জন করেছেন তা বাজেয়াপ্ত করা হোক। তাদের আইনের আওতায় দ্রুত বিচার হোক।
জানা গেছে, মাহবুবসহ আরো অনেক প্রকৌশলী স্বপদে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের আস্থাভাজন হওয়ায় এখনও টিকে আছেন। আর টিকে থাকতে প্রধান প্রকৌশলী আস্থভাজনদের দিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা ।
মাহবুবুর রহমান গণপূর্তের ঢাকা বিভাগ-৪ থাকাকালে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বার্ষিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছে নগদ টাকার বিনিময়ে। মোহাম্মদ শামীম আখতারের সময়ে বরাদ্দ হওয়া এই টাকা কোথায় খরচ করা হয়েছে তার হিসাব দিতে পারেনি নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুব। বিষয়টি তদন্ত করলে ভুয়া বিল-ভাউচারের বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মাহাবুবের এমন ভুয়া বিল-ভাউচার আর টেন্ডারের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক প্রশ্ন তুললে বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে সতীনাথের অফিস ডেকোরেশন নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে কোনঠাসা করে রাখেন। অথচ গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারসহ গণপূর্তে ‘একডজন’ অফিসারের অফিস ডেকোরেশন করেছেন এই দুর্নীতিবাজ মাহাবুব। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি চরম বিদ্বেষী শামীম আখতারের আস্কারা পেয়েই মাহাবুব একের পর এক দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। মাহাবুব সম্প্রতি পাবলিক লাইব্রেরী ভবনের সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার টেন্ডার করেছেন।
নিয়ম অনুযায়ী আগ্রহী দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ শতাংশ কম দরপত্র দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। এই কাজ সাড়ে আট শতাংশ বেশি দরে কাজ দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে সাড়ে ১৮ শতাংশের বেশি টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের। নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এনডিই নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে। যাতে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হবে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির এই সময়ে এতো বেশি টাকা কার্যাদেশ দিয়ে সংশ্লিষ্টরা অতিরিক্ত দরের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এই প্রকল্প থেকে প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার তার সহযোগী কিংডম বিল্ডার্সের নুসরতের মাধ্যমে সাত কোটি টাকা নিয়েছেন। যার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এই মাহাবুব। এরপর থেকেই সকাল-বিকাল মাহাবুবকে দেখা যায় প্রধান প্রকৌশলীর আশেপাশে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলীর মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এ প্রতিবেদককে বলেন, যারা অতিতে দুর্নীতি করেছেন তাদের তালিকা হচ্ছে। যমুনা হাউজ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।সেখানে দেখেশুনো প্রকৌশলী দেওয়া হবে। যারা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন সেসব প্রকৌশলীদের যেন কোনভাবেই না দেওয়া হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখছি।