গত ১০ বছরে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার বেড়েছে সাড়ে ২৪ শতাংশ। বতর্মানে শ্রমবাজারে ২৬-২৮ লাখ কর্মক্ষম বেকার। প্রতিবছর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছে। অন্যদিকে এই মুহূর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাড়ে চার লাখের বেশি পদ শূন্য। কিন্তু এসব পদ পূরণে তেমন দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। এমনকি চলমান রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশের নীতিনির্ধারণী আলোচনা কিংবা সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে তেমন কিছু আমরা শুনছি না।
কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মনে করেন, কিছু কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, একদিকে চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা, সেই সঙ্গে রয়েছে কর্মের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগের অভাব । চাকরির বাজারে যে চাহিদা, সে রকম জনবল আমরা তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতিবছর যেসব শিক্ষিত মানুষ চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের উপযোগী চাকরিও নেই। এ ছাড়া দেশে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এ কারণে উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীর একটি বড় অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে বলে তারা বোঝা হচ্ছেন পরিবার ও রাষ্ট্রের। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চাকরি না পেয়ে বিপুলসংখ্যক বেকার যুবক চরম হতাশা ও মানসিক চাপের মধ্যে দিন পার করছেন।
বেসরকারি খাতে কর্মরত লোকের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারও জানা নেই। তবে এ সেক্টরেই যে দেশের সিংহভাগ মানুষ কাজ করে থাকেন, তা সবারই জানা। এ খাতে কর্মরত ব্যক্তিদের বেকারত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। উন্নয়ন খাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর আকস্মিক তহবিল বন্ধ ঘোষণা এবং কাজের পরিধি সংকুচিত হচ্ছে। সেই কভিডের আক্রমণের পর থেকেই করপোরেট সেক্টর ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান একে একে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় প্রচুর কর্মী এরই মধ্যে ছাঁটাই হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কর্মী নিয়োগে আমাদের মতো দেশের জন্য নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে সিনিয়র ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে চাকরি হারানোর প্রবণতা এখন অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
ফলে তাদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা জাতি গঠনে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে অবদান রাখার ক্ষেত্রে; সর্বোপরি উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে আসছে। একই সঙ্গে কর্মজীবনে নেমে আসা এমন দুঃসময় তাদের পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকায়নেও ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করছে। দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের সঙ্গে দিন দিন যুক্ত হচ্ছে শহুরে নতুন অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত কর্মহীন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা।
এর বাইরে আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি নারীরা শ্রমবাজার থেকে ব্যাপক হারে ছিটকে পড়ছেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৩০ লাখ নারী কাজ করেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্ট হলেও বৈশ্বিক ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বহু নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন কিংবা কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রম অধিকার সংগঠন গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের তথ্য বলছে, গত এক বছরে এক লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। যাদের বড় অংশই এখন পর্যন্ত বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান খুঁজে পাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতির মাঝে বাংলাদেশের পূর্বঘোষিত ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সংকল্প থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনও সরে আসার কোনো ঘোষণা দেয়নি। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তকমা আগামী দিনগুলোতে আমাদের আরও কতটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে, সেটা নিয়েও রাজনীতিবিদসহ দেশের নীতিনির্ধারণী মহলের কোনো ভাবনা দৃশ্যমান নয়।
এই উত্তরণ আপাতদৃষ্টিতে জাতি হিসেবে আমাদের সম্মান বাড়ালেও এই মর্যাদাপ্রাপ্তির ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে গার্মেন্ট শিল্প এবং অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অগ্রাধিকারমূলক ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে, তা আর পাবে না। এলডিসি হিসেবে দাতা দেশগুলো থেকে যে সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে থাকে, তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে। প্রযুক্তি খাতে উন্নত দেশের প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের প্রদত্ত বিভিন্ন সহায়তা ও প্রণোদনাও বন্ধ হবে। ওষুধ খাতেও এর একটি বড় প্রভাব পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশ মেধাস্বত্ব কেনা ছাড়াই ওষুধের ফর্মুলা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশকে প্রতিটি ওষুধ উৎপাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট ফর্মুলার মেধাস্বত্ব কিনে নিতে হবে। এর ফলে উৎপাদন খরচ হবে বহু গুণ। এর প্রভাব পড়বে খুচরা বাজারে।
এমন পরিস্থিতিতে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম অগ্রাধিকার থাকবে বেকারত্ব দূর করার আয়োজন তথা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়া। নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে সবার আগে আবশ্যক হলো দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি। যেখানে আশানুরূপ তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আর বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হলে প্রয়োজন এর প্রতিবন্ধকতাগুলো যেমন জ্বালানি সংকট, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করা। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের বিষয়টি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত।
দেশে এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং বিনিয়োগ না বাড়লে এ সংকট দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে। যার ফল হিসেবে দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ যুব জনগোষ্ঠী আগামী দিনে সামাজিক তো বটেই, রাজনৈতিক সমস্যারও কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
মনজুর রশীদ: সমাজ বিশ্লেষক, লেখক ও গবেষক