আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্রতর সীমান্ত সংঘর্ষ দুই প্রতিবেশীর পুরোনো বিরোধকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। ৯ অক্টোবর থেকে শুরু এ লড়াইয়ে উভয় পক্ষে শতাধিক সেনা ও বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর ৪৮ ঘণ্টার অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও পুনরায় সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার সামরিক বিরোধের নেপথ্যে আছে ঐতিহাসিক ক্ষোভ, সন্ত্রাসবাদের ছায়া ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ।
নানগারহারের স্মৃতি
সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাতে পাকিস্তানি বাহিনী আফগানিস্তানের যেসব এলাকায় হামলা চালিয়েছে, সেখানে নানগারহার প্রদেশও রয়েছে। ২০১৫ সালে আমি আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশের তুর্খাম সীমান্ত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামগুলো পরিদর্শন করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন শিশুশিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষা সহায়তার অগ্রগতি দেখা। মোমান্দ দারা জেলায় খাইবার গিরিপথের কাছে অবস্থিত তুর্খাম সীমান্ত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রধান প্রবেশপথ। এই সীমান্ত দিয়ে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য, পর্যটন ও যাত্রী পরিবহন হয়। এখানে ‘ডুরান্ড লাইন’ আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশকে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে বিভক্ত করেছে।
একটি স্কুল পরিদর্শনের জন্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়েছিল। পৌঁছে দেখি, স্থায়ী ভবন নয়; স্কুলটি শতছিন্ন তাঁবু মাত্র। স্থানীয় শূরার (গ্রাম পরিচালনা কমিটি) উষ্ণ অভ্যর্থনার পর প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সেখানে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম এবং স্কুলের জন্য সরকারি বরাদ্দ ও সহায়তা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। শূরার সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য রফিউল্লাহ আমারখাইল জানান, তৎকালীন তালেবান ও আশরাফ গনি বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাত ছাড়াও পাক-আফগান সংঘর্ষে তাদের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
সংঘাতের ঔপনিবেশিক বীজ
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের কূটনীতিক স্যার মর্টিমার ডুরান্ড এবং আফগান আমির আবদুর রহমান খানের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত সীমান্ত রেখাটি প্রায় দুই হাজার ৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ; আফগানিস্তানের পশ্চিমে ইরান সীমান্ত থেকে পূর্বে চীন-ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু এই সীমান্ত কখনোই আফগানিস্তানের কাছে পূর্ণ স্বীকৃতি পায়নি। তারা এটাকে উপনিবেশবাদী যুগের আরোপিত বিভাজন রেখা বলে মনে করে। পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এটাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে গ্রহণ করলেও আফগানিস্তানের পশতুন জাতি এই রেখার দুই পাশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেটা দুই পাশেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উস্কে দিয়ে আসছে। ২০২১ সালে তালেবানের পুনরায় ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জটিল হয়েছে। ইসলামাবাদের অভিযোগ, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে কাবুল। আর তালেবান সরকারের অভিযোগ, পাকিস্তান সামরিক হস্তক্ষেপ করছে।
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ
সাম্প্রতিক সংঘাতের শুরু হয়েছিল কোয়েটায় একটি রাজনৈতিক সভায় বোমা বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হওয়ার পর। পাকিস্তান এ জন্য টিটিপিকে দায়ী করে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। আফগানিস্তানও পাল্টা আঘাত হানে। চীন এই সংঘাতে ‘সতর্ক মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে উভয় পক্ষকে সংযম ও সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানায়। বেইজিংয়ের স্বার্থ এখানে স্পষ্ট; চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপেক) এবং আফগানিস্তানে খনিজসম্পদ প্রকল্পগুলো যাতে অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্যদিকে, ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময় ছেড়ে যাওয়া বাগরাম বিমানঘাঁটি ‘পুনরুদ্ধার’ করার ইচ্ছা সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশাল এ বিমানঘাঁটি চীনের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কাছাকাছি অবস্থিত। তালেবান সরকার এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, আফগানিস্তানে বিদেশি সামরিক উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। সাম্প্রতিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র যদিও মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, এর পেছনে সন্ত্রাসবাদ দমনের স্বার্থ মুখ্য। কারণ টিটিপি ছাড়াও আইএস-খোরাসানের মতো গোষ্ঠীগুলোকে দেশটি হুমকি মনে করে। আফগানিস্তানে ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণ শিথিল এবং এর ফলে বেইজিংয়ের প্রভাব বৃদ্ধিও সেখানে নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত-আফগান সম্পর্কের সাম্প্রতিক উন্নয়ন এবং তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাম্প্রতিক দিল্লি সফর পাক-আফগান সংঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এটি ২০২১ সালের পর প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর, যেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে সম্পর্কোন্নয়ন, মানবিক সহায়তা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস পুনরায় পুরোপুরি খুলছে এবং নতুন উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। নয়াদিল্লির কৌশলগত লক্ষ্য স্পষ্ট– পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতি-ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে আফগানিস্তানে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রভাব বাড়ানো। কিন্তু এই সম্পর্কোন্নয়ন শান্তির পরিবর্তে সংঘাতের বীজ বপন করতে পারে। চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার বিপরীতে ভারত-আফগান ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে পারে নতুন শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট।
শরণার্থী সংকট
সাম্প্রতিক সংঘাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শরণার্থী ইস্যুও। পাকিস্তানে বর্তমানে ১৬ লক্ষাধিক আফগান শরণার্থী রয়েছে। এর অধিকাংশই ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত আক্রমণ থেকে ২০০১ সালের মার্কিন হামলা এবং সাম্প্রতিক তালেবান শাসনের কারণে পালিয়ে এসেছে। তারা মূলত পশতুন, হাজারা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর; যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে পালিয়েছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের শেষ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান নথিহীন ও নথিসহ ৬ লক্ষাধিক শরণার্থীকে ফেরত পাঠিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই ফেরত যেতে অনিচ্ছুক ছিল এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, এই প্রক্রিয়া নারী-শিশুসহ ভুক্তভোগী গোষ্ঠীর ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। তালেবান সরকারও তাদের ফেরত নিতে চায় না অর্থনৈতিক বোঝা বিবেচনা করে। আর পাকিস্তানের অভিযোগ, শরণার্থীদের মধ্যে টিটিপি যোদ্ধারা মিশে রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা
আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সাম্প্রতিক সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। যেমন বামিয়ান প্রদেশের পাঞ্জাব জেলায় তালেবান স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করছে, যা কোচি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধের কারণে হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসেই রাশক, তোবাক, গুলি, হোজ মাহমুদসহ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের জমি ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে এবং অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এতে বাস্তুচ্যুত হাজারা সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা এথনিক ক্লিনজিংয়ের অভিযোগ তুলেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বামিয়ানের পাঞ্জাব জেলায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ ধরনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ সীমান্ত সংঘাতকে আরও উস্কে দেয়। বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত আফগানদের মধ্যে গোষ্ঠীগত উত্তেজনা ও সংঘাত দেখা দেয়। যেহেতু ডুরান্ড লাইন বরাবর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে অভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস; গোষ্ঠীগত উত্তেজনা ও সংঘাত সীমান্তের উভয় পাশেই ছড়িয়ে পড়ে।
বিরতি, কিন্তু সমাপ্তি নয়
পাক-আফগান সংঘাতের বিরতি সম্ভব হয়েছে; সমাপ্তি সহজ নয়। দুই দেশের সংঘর্ষ ঐতিহাসিক বিরোধের ফসল, যা সন্ত্রাসবাদ, শরণার্থী সংকট ও ভূ-রাজনৈতিক খেলায় আরও জটিল হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিরোধের সমাধান না হলে সংঘাতের ছায়া দীর্ঘায়িত হবে। এক দশক আগে নানগারহার পরিদর্শন আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, দুঃখ-কষ্ট এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সংঘাত-সংকুল পরিবেশেও তাদের মুখে হাসি ও আশার আলো খেলা করে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কথা হচ্ছে, সেই আশা ও স্বপ্ন কাবুল এবং ইসলামাবাদকে প্রভাবিত করে না।
এফ এম আনোয়ার হোসেন: উন্নয়ন ও পরিবেশকর্মী