আসামী এখন বিআইডব্লিউটিএ’র ‘রাজার রাজা’!

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : ০৭:১৭:৩৭ অপরাহ্ন, সোমাবার, ৭ নভেম্বর ২০২২
  • / 470

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)তে সিবিএ’র সভাপতি আবুল হোসেনের রাজত্ব চলছে। কৌশলে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য, ঠিকাদারী বাণিজ্য সহ অবৈধভাবে অঢেল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনিয়মের মাধ্যমে নামে-বেনামে এসব সম্পদ অর্জন করায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর তা তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। কিন্তু তারও ফলাফল শুন্য। রাজনৈতিক প্রভাব আর টাকার ভারে সে সব অপরাধ চাপা পড়ে আছে বছরের পর বছর। আর সেই সুযোগে বিআইডব্লিউটিএতে আবুল হোসেন এখন ‘রাজার রাজা’ বনে গেছেন। গড়ে তুলেছেন সিবিএ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের তিনিই রাজাধিরাজ।

গত প্রায় এক দশক ধরে তিনি সিবিএ নেতার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কিত করে ফেলেছেন। বানিয়েছেন লুটপাটের আখড়া। কথায় কথায় কর্মকর্তাদের হুমকি ধামকি দেওয়ার পাশা পাশি বদলী, নিয়োগ, টেন্ডার খাতে অবৈধ হস্তক্ষেপ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। নিজে একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হলেও ব্যবহার করছেন অফিসারদের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ী। সিবিএ অফিসটাকে বানিয়েছেন সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে বসে নানা প্রকার অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। বিআইডব্লিউটিএ ভবনে তার অবিশ্বাস্য দাপট দেখলে যে কোন সচেতন নাগরিকই বিস্মিত হবেন। সয়ং চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকও তার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস দেখান না।

সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের একাধিক নিকটাত্মীয় বিআইডব্লিউটিএ’র বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। আবুলের ভাগিনা আলামিন চাকরি করেন লস্কর পদে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশের ধার ধারেন না তিনি। আবুলের ভাই মেহেদী হাসানও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারী। তবে মেহেদীর চাকরি হয় বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে। বয়স জালিয়াতি করে মার্কম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে।

আবুলের মেয়ের জামাই বিআইডব্লিউটিএ’র তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, আবুল হোসেন নিম্নমান সহকারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন। পরে সহকারী হিসেবে তার পদোন্নতি হয়।

তবে সিবিএ’র নেতাগিরি করার জন্য তিনি আর পদোন্নতি নিতে রাজি নন। এমনকি নিজের পদোন্নতি আটকে রাখতে নিজেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসিআর বুকে নেতিবাচক মন্তব্য লিখিয়ে নেন। আবুলের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায়। নিজের এলাকায় তিনি আদম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের মেডিকেল এটেন্ডেন্ট মো. মুজিবর রহমান। অভিযোগে উল্খে করা হয়- তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও আবুল হোসেন সরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিআইডব্লিটি’র একাধিক কর্মচারী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পাশাপাশি ভুয়া মামলায় আসামিও হয়েছেন। এমনকি বদলি, বরখাস্ত করা হয়েছে বেশ কয়েক কর্মচারীকে। দুই নেতার অনাচার থেকে বাঁচতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো অভিযোগকারীদের নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হতে হয়েছে।

কাজ না করেই ৫০ লাখ টাকা লোপাট: বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে তার জামাতার (মেয়ের স্বামী) নামে করা লাইসেন্সে (এআরটেল বিডি লিমিটেড) বিআইডব্লিউটিএতে রমরমা ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন। এভাবে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি। যদিও বিধি অনুযায়ী বিআইডব্লিউটি’র কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী বা তাদের নিকটাত্মীয় এই সংস্থার লাভজনক কাজে যুক্ত হতে পারেন না।

জানা গেছে, গত বছর জুলাই মাসে সিলেটের গোয়াইন ঘাটে সালিটিকর ঘাটে একটি ৮০ ফুট জেটি নির্মানের জন্য কাজ পায় ঢাকার মেসার্স তানিয়া এন্টাপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্ত সিডিউল মোতাবেক ৯০ ফুট দীর্ঘ এ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৮০ ফুট দীর্ঘ নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ না করেই কেবলমাত্র ৫০ ফুটের একটি স্টিল অবকাঠামো নির্মান করেই ৫০ লক্ষ ৩৯ হাচার টাকা বিল তুলে নেয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি সভাপতি আবুল হোসেনের জামাইয়ের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। এ বিষয়টি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ হলেও কোন ব্যবস্খা নেন নি বিআইডব্লিটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক।

এছাড়া আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে আপন ছোট ভাই চল্লিশোর্ধ বয়সী মেহেদী হাসানকে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে বিআইডব্লিউটি’তে মার্কম্যান পদে চাকরি দিয়েছেন। বিষয়টি জানাজনি হলে তাড়াহুড়া করে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংশোধন করা হয়। তবে মেহেদীর এসএসসি পাসের সনদে দেখা যায়, তার বয়স চল্লিশের বেশি। অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুল হোসেন অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস কর্মচারী নিয়োগ ও বদলি। গত ৩ বছরে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়, ড্রেজারসহ বিভিন্ন জলযান, নদীবন্দর ও শাখা কার্যালয়গুলোতে বিভিন্ন পদে ৫ শতাধিক কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দেড়শ’ নিয়োগ দেয়া হয়েছে আবুল হোসেনের তদবিরে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রতি পাঁচ লাখ থেকে বারো লাখ টাকা নিয়েছেন। এছাড়া এ সিবিএ নেতা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ২০০ কর্মচারীকে বদলি ও বদলিকৃতদের পছন্দের স্থানে পদায়ন করিয়েছেন। এর বিনিময়ে তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, সিবিএ সভাপতির এসব অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করায় সংগঠনের কয়েকজন নেতাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের ঢাকার বাইরে বদলি করিয়েছেন। তাদের কয়েকজন হলেন বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ১নং যুগ্ম সম্পাদক সঞ্জীব দাশ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক তুষার কান্তি বণিক, মুজিবর রহমান ও মাযহার হোসেন।

বিআইডব্লিউটিএর একটি সূত্রে জানা গেছে, সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন বিআইডব্লিউটিএর একজন পরিচালকের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ ৩৭-৭৪৩৭) ২০১৬ সালের জুলাই থেকে গত ১১ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয়, গাড়ির পেছনে ব্যয় হওয়া প্রায় ৭ লাখ টাকার জ্বালানি এবং চালকের বেতন-ভাতা ৫ লাখ টাকা বহন করেছে কর্তৃপক্ষ। দুদক এক অভিযান চালিয়ে পিডিবির দুই সিবিএ নেতার দখলে থাকা দুটি গাড়ি উদ্ধারের পর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ আবুলের গাড়ি প্রত্যাহার করেছে। তবে আবুল হোসেন দীর্ঘদিন বেআইনিভাবে গাড়িটি ব্যবহার করেছেন- এই তথ্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য লগবুকসহ দাপ্তরিক আলামতগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি চেয়ারম্যানের অজ্ঞাতে প্রকল্পের গাড়ী ব্যবহার করছেন।

দুদকের অভিযোগ থেকে মুক্তির নেপথ্যে:বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ সভাপতির বিরুদ্ধে করা অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছিল দুদক। যার স¥ারক নং ০০.০১.০০০০.৫০২.০১.০৭০.১৭-৩৫৪৯৯/১(৫) তারিখ: ১৫/০৯/২০১৯ইং।

অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নোটিশ পাঠানো হয়। ওই নোটিশে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য বলা হয়েছিল। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি দুদকের পক্ষ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে সিবিএ নেতার পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও পরিবারের সদস্যদের সকল সম্পদ, ব্যাংক হিসাবসহ ১২ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়। ২৭শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে এসব তথ্য দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগে গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (টিএ) মো. আনোয়ারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. আবদুস ছাত্তারকে এই সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়।

চিঠিতে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ নেতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সরজমিনে তদন্তপূর্বক সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হলো। কিন্তু কাকের মাংস কাকে খায়নি। তাই বিভাগীয় ও দুদকের তদন্তে তিনি দায়মুক্তি পেয়েছেন। তবে কত টাকার বিনিময়ে তিনি দামুক্তি পেয়েছেন তা এখনো প্রশ্নই রয়েগেছে।

আত্মসাৎ : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) এবং শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের প্রায় ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সংস্থার পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ উপার্জনের অভিযোগের বিষয়েও চলছে পৃথক অনুসন্ধান শুরু হয়। অভিযুক্তদের কয়েকজনকে দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ও স্ত্রী-সন্তানদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এসব খতিয়ে দেখতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং দুদক পৃথক দু’জন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগও করেছিলো। অভিযোগ পাওয়া গেছে, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের খানপুর আরসিসি জেটি, সারুলিয়া পয়েন্টসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা নিতেন তিনি।

এ ছাড়া সংস্থার বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। কর্মচারীদের ঢাকার বাইরে বদলির ভয় দেখিয়ে এবং অনেক প্রার্থীকে সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং করিয়ে জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগে আরও বলা হয়, গত তিন বছরে নিয়োগ, বদলি, ঘাট ইজারা, টোল আদায়, নামে-বেনামে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ বিআইডব্লিউটিএতে সিবিএর নামে যত অপকর্ম হয়েছে, তার সঙ্গে এই নেতাই জড়িত।

সূত্রমতে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মতিঝিল করপোরেট শাখায় বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের হিসাব থেকে সাধারণ কর্মচারীদের না জানিয়ে কয়েক দফায় ১২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। অন্যদিকে একই ব্যাংকের একই শাখায় বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয় ১১ লাখ ৬১ হাজার টাকা।

শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় অদৃশ্য কারণে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তদন্তে কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নাজমুলকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ : বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগে বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন-সিবিএর সভাপতি মো. আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ মামলা দায়ের করা হয়। যার মামলা নং- ১৫১৬/২০২১।
ধারা ৫০০/৫০৬ দঃ বিঃ আইন। মামলাটি করেন চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর থানার বড়লক্ষীপুর গ্রামের তাজুল ইসলামের পুত্র মো. ওসমান গনি। ওসমান গনি বিআইডব্লিউটিএ ফ্লোটিং ওয়ার্কস ইউনিয়নের সভাপতি ও বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত কোয়ার্টার মাস্টার। যার রেজিঃ বি-১২৩০ (জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত) ১৪১-১৪৩।

আরো জানাগেছে, ২০১৭ সালে উক্ত সংগঠনের উপস্থিত সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয় আবুল হোসেনকে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার স্মারক নং- ১৮০১৬.০২৭.০০.০০.০০২.২০১০-১২৩৩ মোতাবেক ঢাকার বাইরে বদলীসহ ৫টি শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।

এছাড়াও সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অঢেল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ উঠে। নিয়োগ, বদলি বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে নামে-বেনামে তিনি এসব সম্পদ অর্জন করেছেন। আবুল হোসেন রাজধানীর সবুজবাগ থানার কাঠেরপুল এলাকার মৃত শিরু মিয়ার পুত্র।

এই মামলা করায় সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের নির্দেশে সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম ও তার বাহিনী মামলা বাদী ওসমান গনিকে মারধর করে গুরুতর আহত করে সকাল ৯টার দিকে বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ অফিসের ভিতরে এ ঘটনা ঘটে। ওসমান গনি সাংবাদিকদেক কাছে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ আমি মামলা দায়ের করেছি।

এজন্য আবুল হোসেন আমার ওপর রেগে গিয়ে সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম ও তার বাহিনী দিয়ে আমার ওপর হামলা চালায়। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। এ সময় ওই মামলার ১নং সাক্ষী মো. সুমনকেও ওরা মারধর করেছে। সুমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ওই সময় হামলাকারীরা মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিভিন্ন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এ সময় আমার সাথে থাকা মামলার কাগজপত্র ও দুটি মোবাইল ফোনসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও জিনিসও ছিনিয়ে নেয়।

তখন মারধরের অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন-সিবিএর সভাপতি মো. আবুল হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি কয়েকদিন যাবত অসুস্থ। এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

মামলার অভিযোগ মতে, আবুল হোসেন বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন সিবিএ রেজিঃ নং- বি- ২১৭৬ এর বহিষ্কৃত সভাপতি। তিনি বিআইডব্লিউটিএর হিসাব শাখায় অফিস সহকারী কাম কোষাধ্যক্ষ পদে কর্মরত আছেন। ট্রেড ইউনিনের নিয়ম অনুযায়ী কোষাধ্যক্ষ পদে কর্মরত থেকে কোন কর্মচারী ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে পারেন না।

তারপরও তিনি উক্ত নিয়ম ভঙ্গ করে বিধি বহির্ভূতভাবে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করে এবং অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে অর্থ প্রতিপত্তির জোরে সিবিএ ট্রেড রাজনীতিতে জোরপূর্বক প্রবেশ করেন। সভাপতির পদ ধরে রেখে বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারীদের ওপর অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হন এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হওয়ার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তার অপরাধ ও দুর্নীতির বিষয়ে ১৫টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ : আবুল হোসেন বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন সিবিএ রেজিঃ নং- বি- ২১৭৬ এর বহিষ্কৃত সভাপতি হলেও অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেন না বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। বরং তিনিও আবুল হোসেনকে ছায়া মায়া দিয়ে লালন পালন করছেন। কিন্তু কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানাগেছে, বিআইডব্লিউটিএতে যতো প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তা যাতে বাইরে বা মিডিয়ায় প্রকাশ না হয় সেজন্য সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের অবৈধ দাবী মিটিয়ে তাকে ঠান্ডা করে রাখা হয়। অন্য দিকে আবুল হোসেন যে কর্মচারীকেই বদলী করতে বলেন তাকেই সাথে সাথে বদলী করে দেওয়া হয়। এই চর্চা চলে আসছে প্রায় ২ বছর ধরে।

যে কারণে আবুল হোসেন নিজেকে বিআইডব্লিউটিএর ‘রাজার রাজা’ মনে করেন। এ বিষয়ে অধিকাংশ কর্মচারী চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষুব্ধ রয়েছেন। তারা এই সিবিএ দুর্বৃত্তের কালোথাবা থেকে মুক্তি চান। এ জন্য তারা প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা,নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও নৌ সচিবের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেনের একাধিক মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

আসামী এখন বিআইডব্লিউটিএ’র ‘রাজার রাজা’!

আপডেট : ০৭:১৭:৩৭ অপরাহ্ন, সোমাবার, ৭ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)তে সিবিএ’র সভাপতি আবুল হোসেনের রাজত্ব চলছে। কৌশলে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য, ঠিকাদারী বাণিজ্য সহ অবৈধভাবে অঢেল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনিয়মের মাধ্যমে নামে-বেনামে এসব সম্পদ অর্জন করায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর তা তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। কিন্তু তারও ফলাফল শুন্য। রাজনৈতিক প্রভাব আর টাকার ভারে সে সব অপরাধ চাপা পড়ে আছে বছরের পর বছর। আর সেই সুযোগে বিআইডব্লিউটিএতে আবুল হোসেন এখন ‘রাজার রাজা’ বনে গেছেন। গড়ে তুলেছেন সিবিএ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের তিনিই রাজাধিরাজ।

গত প্রায় এক দশক ধরে তিনি সিবিএ নেতার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কিত করে ফেলেছেন। বানিয়েছেন লুটপাটের আখড়া। কথায় কথায় কর্মকর্তাদের হুমকি ধামকি দেওয়ার পাশা পাশি বদলী, নিয়োগ, টেন্ডার খাতে অবৈধ হস্তক্ষেপ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। নিজে একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হলেও ব্যবহার করছেন অফিসারদের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ী। সিবিএ অফিসটাকে বানিয়েছেন সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে বসে নানা প্রকার অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। বিআইডব্লিউটিএ ভবনে তার অবিশ্বাস্য দাপট দেখলে যে কোন সচেতন নাগরিকই বিস্মিত হবেন। সয়ং চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকও তার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস দেখান না।

সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের একাধিক নিকটাত্মীয় বিআইডব্লিউটিএ’র বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। আবুলের ভাগিনা আলামিন চাকরি করেন লস্কর পদে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশের ধার ধারেন না তিনি। আবুলের ভাই মেহেদী হাসানও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারী। তবে মেহেদীর চাকরি হয় বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে। বয়স জালিয়াতি করে মার্কম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে।

আবুলের মেয়ের জামাই বিআইডব্লিউটিএ’র তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, আবুল হোসেন নিম্নমান সহকারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন। পরে সহকারী হিসেবে তার পদোন্নতি হয়।

তবে সিবিএ’র নেতাগিরি করার জন্য তিনি আর পদোন্নতি নিতে রাজি নন। এমনকি নিজের পদোন্নতি আটকে রাখতে নিজেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসিআর বুকে নেতিবাচক মন্তব্য লিখিয়ে নেন। আবুলের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায়। নিজের এলাকায় তিনি আদম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের মেডিকেল এটেন্ডেন্ট মো. মুজিবর রহমান। অভিযোগে উল্খে করা হয়- তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও আবুল হোসেন সরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিআইডব্লিটি’র একাধিক কর্মচারী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পাশাপাশি ভুয়া মামলায় আসামিও হয়েছেন। এমনকি বদলি, বরখাস্ত করা হয়েছে বেশ কয়েক কর্মচারীকে। দুই নেতার অনাচার থেকে বাঁচতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো অভিযোগকারীদের নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হতে হয়েছে।

কাজ না করেই ৫০ লাখ টাকা লোপাট: বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে তার জামাতার (মেয়ের স্বামী) নামে করা লাইসেন্সে (এআরটেল বিডি লিমিটেড) বিআইডব্লিউটিএতে রমরমা ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন। এভাবে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি। যদিও বিধি অনুযায়ী বিআইডব্লিউটি’র কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী বা তাদের নিকটাত্মীয় এই সংস্থার লাভজনক কাজে যুক্ত হতে পারেন না।

জানা গেছে, গত বছর জুলাই মাসে সিলেটের গোয়াইন ঘাটে সালিটিকর ঘাটে একটি ৮০ ফুট জেটি নির্মানের জন্য কাজ পায় ঢাকার মেসার্স তানিয়া এন্টাপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্ত সিডিউল মোতাবেক ৯০ ফুট দীর্ঘ এ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৮০ ফুট দীর্ঘ নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ না করেই কেবলমাত্র ৫০ ফুটের একটি স্টিল অবকাঠামো নির্মান করেই ৫০ লক্ষ ৩৯ হাচার টাকা বিল তুলে নেয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি সভাপতি আবুল হোসেনের জামাইয়ের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। এ বিষয়টি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ হলেও কোন ব্যবস্খা নেন নি বিআইডব্লিটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক।

এছাড়া আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে আপন ছোট ভাই চল্লিশোর্ধ বয়সী মেহেদী হাসানকে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে বিআইডব্লিউটি’তে মার্কম্যান পদে চাকরি দিয়েছেন। বিষয়টি জানাজনি হলে তাড়াহুড়া করে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংশোধন করা হয়। তবে মেহেদীর এসএসসি পাসের সনদে দেখা যায়, তার বয়স চল্লিশের বেশি। অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুল হোসেন অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস কর্মচারী নিয়োগ ও বদলি। গত ৩ বছরে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়, ড্রেজারসহ বিভিন্ন জলযান, নদীবন্দর ও শাখা কার্যালয়গুলোতে বিভিন্ন পদে ৫ শতাধিক কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দেড়শ’ নিয়োগ দেয়া হয়েছে আবুল হোসেনের তদবিরে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রতি পাঁচ লাখ থেকে বারো লাখ টাকা নিয়েছেন। এছাড়া এ সিবিএ নেতা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ২০০ কর্মচারীকে বদলি ও বদলিকৃতদের পছন্দের স্থানে পদায়ন করিয়েছেন। এর বিনিময়ে তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, সিবিএ সভাপতির এসব অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করায় সংগঠনের কয়েকজন নেতাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের ঢাকার বাইরে বদলি করিয়েছেন। তাদের কয়েকজন হলেন বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ১নং যুগ্ম সম্পাদক সঞ্জীব দাশ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক তুষার কান্তি বণিক, মুজিবর রহমান ও মাযহার হোসেন।

বিআইডব্লিউটিএর একটি সূত্রে জানা গেছে, সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন বিআইডব্লিউটিএর একজন পরিচালকের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ ৩৭-৭৪৩৭) ২০১৬ সালের জুলাই থেকে গত ১১ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয়, গাড়ির পেছনে ব্যয় হওয়া প্রায় ৭ লাখ টাকার জ্বালানি এবং চালকের বেতন-ভাতা ৫ লাখ টাকা বহন করেছে কর্তৃপক্ষ। দুদক এক অভিযান চালিয়ে পিডিবির দুই সিবিএ নেতার দখলে থাকা দুটি গাড়ি উদ্ধারের পর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ আবুলের গাড়ি প্রত্যাহার করেছে। তবে আবুল হোসেন দীর্ঘদিন বেআইনিভাবে গাড়িটি ব্যবহার করেছেন- এই তথ্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য লগবুকসহ দাপ্তরিক আলামতগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি চেয়ারম্যানের অজ্ঞাতে প্রকল্পের গাড়ী ব্যবহার করছেন।

দুদকের অভিযোগ থেকে মুক্তির নেপথ্যে:বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ সভাপতির বিরুদ্ধে করা অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছিল দুদক। যার স¥ারক নং ০০.০১.০০০০.৫০২.০১.০৭০.১৭-৩৫৪৯৯/১(৫) তারিখ: ১৫/০৯/২০১৯ইং।

অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নোটিশ পাঠানো হয়। ওই নোটিশে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য বলা হয়েছিল। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি দুদকের পক্ষ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে সিবিএ নেতার পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও পরিবারের সদস্যদের সকল সম্পদ, ব্যাংক হিসাবসহ ১২ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়। ২৭শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে এসব তথ্য দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগে গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (টিএ) মো. আনোয়ারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. আবদুস ছাত্তারকে এই সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়।

চিঠিতে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ নেতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সরজমিনে তদন্তপূর্বক সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হলো। কিন্তু কাকের মাংস কাকে খায়নি। তাই বিভাগীয় ও দুদকের তদন্তে তিনি দায়মুক্তি পেয়েছেন। তবে কত টাকার বিনিময়ে তিনি দামুক্তি পেয়েছেন তা এখনো প্রশ্নই রয়েগেছে।

আত্মসাৎ : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) এবং শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের প্রায় ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সংস্থার পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ উপার্জনের অভিযোগের বিষয়েও চলছে পৃথক অনুসন্ধান শুরু হয়। অভিযুক্তদের কয়েকজনকে দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ও স্ত্রী-সন্তানদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এসব খতিয়ে দেখতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং দুদক পৃথক দু’জন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগও করেছিলো। অভিযোগ পাওয়া গেছে, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের খানপুর আরসিসি জেটি, সারুলিয়া পয়েন্টসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা নিতেন তিনি।

এ ছাড়া সংস্থার বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। কর্মচারীদের ঢাকার বাইরে বদলির ভয় দেখিয়ে এবং অনেক প্রার্থীকে সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং করিয়ে জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগে আরও বলা হয়, গত তিন বছরে নিয়োগ, বদলি, ঘাট ইজারা, টোল আদায়, নামে-বেনামে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ বিআইডব্লিউটিএতে সিবিএর নামে যত অপকর্ম হয়েছে, তার সঙ্গে এই নেতাই জড়িত।

সূত্রমতে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মতিঝিল করপোরেট শাখায় বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের হিসাব থেকে সাধারণ কর্মচারীদের না জানিয়ে কয়েক দফায় ১২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। অন্যদিকে একই ব্যাংকের একই শাখায় বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয় ১১ লাখ ৬১ হাজার টাকা।

শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় অদৃশ্য কারণে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তদন্তে কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নাজমুলকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ : বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগে বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন-সিবিএর সভাপতি মো. আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ মামলা দায়ের করা হয়। যার মামলা নং- ১৫১৬/২০২১।
ধারা ৫০০/৫০৬ দঃ বিঃ আইন। মামলাটি করেন চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর থানার বড়লক্ষীপুর গ্রামের তাজুল ইসলামের পুত্র মো. ওসমান গনি। ওসমান গনি বিআইডব্লিউটিএ ফ্লোটিং ওয়ার্কস ইউনিয়নের সভাপতি ও বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত কোয়ার্টার মাস্টার। যার রেজিঃ বি-১২৩০ (জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত) ১৪১-১৪৩।

আরো জানাগেছে, ২০১৭ সালে উক্ত সংগঠনের উপস্থিত সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংগঠনের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয় আবুল হোসেনকে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার স্মারক নং- ১৮০১৬.০২৭.০০.০০.০০২.২০১০-১২৩৩ মোতাবেক ঢাকার বাইরে বদলীসহ ৫টি শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।

এছাড়াও সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অঢেল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ উঠে। নিয়োগ, বদলি বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে নামে-বেনামে তিনি এসব সম্পদ অর্জন করেছেন। আবুল হোসেন রাজধানীর সবুজবাগ থানার কাঠেরপুল এলাকার মৃত শিরু মিয়ার পুত্র।

এই মামলা করায় সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের নির্দেশে সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম ও তার বাহিনী মামলা বাদী ওসমান গনিকে মারধর করে গুরুতর আহত করে সকাল ৯টার দিকে বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ অফিসের ভিতরে এ ঘটনা ঘটে। ওসমান গনি সাংবাদিকদেক কাছে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ আমি মামলা দায়ের করেছি।

এজন্য আবুল হোসেন আমার ওপর রেগে গিয়ে সিবিএ নেতা রফিকুল ইসলাম ও তার বাহিনী দিয়ে আমার ওপর হামলা চালায়। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। এ সময় ওই মামলার ১নং সাক্ষী মো. সুমনকেও ওরা মারধর করেছে। সুমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ওই সময় হামলাকারীরা মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিভিন্ন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এ সময় আমার সাথে থাকা মামলার কাগজপত্র ও দুটি মোবাইল ফোনসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও জিনিসও ছিনিয়ে নেয়।

তখন মারধরের অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন-সিবিএর সভাপতি মো. আবুল হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি কয়েকদিন যাবত অসুস্থ। এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

মামলার অভিযোগ মতে, আবুল হোসেন বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন সিবিএ রেজিঃ নং- বি- ২১৭৬ এর বহিষ্কৃত সভাপতি। তিনি বিআইডব্লিউটিএর হিসাব শাখায় অফিস সহকারী কাম কোষাধ্যক্ষ পদে কর্মরত আছেন। ট্রেড ইউনিনের নিয়ম অনুযায়ী কোষাধ্যক্ষ পদে কর্মরত থেকে কোন কর্মচারী ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে পারেন না।

তারপরও তিনি উক্ত নিয়ম ভঙ্গ করে বিধি বহির্ভূতভাবে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করে এবং অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে অর্থ প্রতিপত্তির জোরে সিবিএ ট্রেড রাজনীতিতে জোরপূর্বক প্রবেশ করেন। সভাপতির পদ ধরে রেখে বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারীদের ওপর অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হন এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হওয়ার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তার অপরাধ ও দুর্নীতির বিষয়ে ১৫টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ : আবুল হোসেন বিআইডব্লিউটিএর শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন সিবিএ রেজিঃ নং- বি- ২১৭৬ এর বহিষ্কৃত সভাপতি হলেও অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেন না বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। বরং তিনিও আবুল হোসেনকে ছায়া মায়া দিয়ে লালন পালন করছেন। কিন্তু কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানাগেছে, বিআইডব্লিউটিএতে যতো প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তা যাতে বাইরে বা মিডিয়ায় প্রকাশ না হয় সেজন্য সিবিএ নেতা আবুল হোসেনের অবৈধ দাবী মিটিয়ে তাকে ঠান্ডা করে রাখা হয়। অন্য দিকে আবুল হোসেন যে কর্মচারীকেই বদলী করতে বলেন তাকেই সাথে সাথে বদলী করে দেওয়া হয়। এই চর্চা চলে আসছে প্রায় ২ বছর ধরে।

যে কারণে আবুল হোসেন নিজেকে বিআইডব্লিউটিএর ‘রাজার রাজা’ মনে করেন। এ বিষয়ে অধিকাংশ কর্মচারী চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষুব্ধ রয়েছেন। তারা এই সিবিএ দুর্বৃত্তের কালোথাবা থেকে মুক্তি চান। এ জন্য তারা প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা,নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও নৌ সচিবের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেনের একাধিক মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।