ঢাকা ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন রাজউকের সবুজ-মলি!

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : ০৫:৪২:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩
  • / 334

অনেকের কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য এবং নিছক গল্প মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- রাজউকে চাকরি মানেই যেন সোনার ডিমপাড়া হাঁস কিংবা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাওয়ার সমান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নামক সরকারী। এই প্রতিষ্ঠানকে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রীতিমতো ‘টাকা তৈরীর কারখানায়’ পরিণত করেছে। এখানে টাকা আয়ের বিষয়ে ‘পদ-পদবী’ কোন বাধাই নয়। সম্প্রতি রাজউকের দুই কর্মচারীর নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগের কপি এ প্রতিবেদকের হাতে পৌঁছেছে।

২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর মো. আমিনুল ইসলাম নামে জনৈক ব্যক্তি রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর জাহিদুল ইসলাম সবুজের নামে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজউকের সর্বস্তরের কর্মচারীদের পক্ষে একই ব্যক্তির নামে দুদকে লিখিত আবেদন করেন জনৈক মো. হেলাল উদ্দীন। আবেদনকারী ভিন্ন হলেও অভিযুক্তের বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগের ধরণ একই।অভিযোগ মতে, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের কার্যকরী সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সবুজ। কোটি কোটি টাকার মালিক!

সরকারী স্কেল অনুযায়ী মাত্র ২৫/৩০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী হয়েও কীভাবে এবং কোন উপায়ে তিনি এতো টাকার মালিক হলেন- তা বোধগম্য নয়। উল্লেখিত ব্যক্তি রাজউকে কোনকিছুরই তোয়াক্কা করেন না, নিজের খেয়াল-খুশিমতো অফিস করেন তিনি। অফিসের কাজ ফেলে অধিকাংশ সময়েই বিভিন্ন ফাইলের দালালীতে ব্যস্ত থাকেন। সবুজের তদবীরকৃত ফাইলে স্বাক্ষর না করলে কর্মকর্তাদের নানা রকমের হুমকিসহ তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল ও শারিরিক নির্যাতন করেন বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে সবুজের বিরুদ্ধে।

অভিযোগে আরও জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে রাজউকে যোগদানের পর থেকেই নানা অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ সবুজের বিরুদ্ধে। গত পাঁচ বছর রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখায় থেকে ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি, গড়েছেন বাড়ি-গাড়ি সম্পদের পাহাড়! দাপটের সাথে অনিয়ম-দুর্নীতি করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে সবুজ। বর্তমানে উচ্চমান সহকারী হিসেবে (অ. দা.) দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর গনমাধ্যমে প্রকাশিত ‘‘ঘুষের ওপেন হার্ট রাজউক: প্রভাবশালীদের পেছনে রাজনীতির শক্ত খুঁটি” প্রতিবেদনে উল্লেখিত ‘৪২১’ নম্বর কক্ষটিতেই বসেন জাহিদুল ইসলাম সবুজ। এই কক্ষেই ঘুষের যাবতীয় লেনদেন হয়ে থাকে সবুজের মধ্যস্থতায়। ফাইলের নথি গায়েব থেকে শুরু করে এক প্লট একাধিকজনের কাছে বিক্রি কিংবা প্যাকেজ ঘুষ, সব জায়গায় সবুজের ক্যারিশমাটিক ছোঁয়া আছে। রাজউকে ঘুষখোর এবং ধুরন্ধর কর্মচারীদের একজন হচ্ছেন- জাহিদুল ইসলাম সবুজ এস্টেট ও ভূমি-২ শাখায় ঘুষ লেনদেনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সবুজ। ঘুষের টাকায় রাজধানী মাদারটেক কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় ১০ কাঠা জমিতে বেজমেন্টসহ নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনে একাধিক শেয়ার কিনেছেন সবুজ।

গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বগুড়া শেরপুরেও বাড়ি করেছেন। সবুজের একটি নোহা ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাস আছে যার নম্বর ঢাকা মেট্রো- ৫১৮৯৩৭। এছাড়াও গাজীপুর জেলার ভবানীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে সংলগ্ন “রাজেন্দ্র ইকো রিসো অ্যান্ড ভিলেজ” নামে ৪ তলার অত্যাধুনিক ভবনের শেয়ারহোল্ডার জাহিদুল ইসলাম সবুজ। প্রায় প্রতিরাতেই বিভিন্ন বয়সী নারীদের অশ্লীল নৃত্য আর মদের আসর বসে ওই রিসোর্টে। সেই আসরের নিয়মিত মেহমান জাহিদুল ইসলাম সবুজ। রাজউকের সামান্য বেতনের একজন কর্মচারী হয়েও রাজকীয় জীবন-যাপন করেন তিনি। কাকরাইলে অবস্থিত ‘হোটেল রাজমণি’ ‘ঈশাখা’সহ রাজধানীর অভিজাত এলাকার ‘নামীদামী’ সব ক্লাব ও বারগুলোতে নিয়মিত মদপান ও নর্তকী নিয়ে নাচানাচি করেন সবুজ। মাতাল হয়ে নর্তকীদের শরীরে দু’হাতে টাকা ছিটানো তার প্রতিদিনের নেশা।

ফাতেমা বেগম মলি: অপরদিকে রাজউক জোন-৫ এর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও উচ্চমান সহকারী (অ. দা.) ফাতেমা বেগম মলির স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন মেহেদী হাসান নামের জনৈক ভুক্তভোগী। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দাখিলকৃত ওই অভিযোগে বলা হয়, দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে রাজউকের ঠিকাদারদের জিম্মি করে রেখেছেন মলি।

প্রাক্কলন, চুক্তিপত্র, বোর্ড সভার কর্মপত্র, ঠিকাদারদের বিল এবং প্ল্যান পাসের নথিসহ কোন ফাইলই টাকা ছাড়া ছাড়েন না। মলির অনিয়ম দুর্নীতির কারনে ঠিকানার ও গ্রাহক হয়রানি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার মালিক ফাতেমা বেগম মলি। রাজধানীর পূর্বাচলে ১৭নং সেক্টরে ৫ কাঠার একটি প্লট, ২২ নং সেক্টরে ৫ কাঠার একটি এবং ২৭ নং সেক্টরে ৫ কাঠার আরও একটি প্লটের মালিক মলি। রাজধানীর ঝিগাতলায় ১৫/এ, ডার্লি পয়েন্টে, হাফিজুল্লাহ গ্রীণ টাওয়ারে (লেভেল ই-৫) কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ৩টি ফ্ল্যাট আছে মলির। এছাড়া নারায়ণগঞ্জসহ মলির গ্রামের বাড়ি চাঁদপরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দামী নোহা গাড়ীতে (ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৬১৮) চড়ে অফিসে আসেন তিনি। একজন উচ্চমান সহকারি কীভাবে ফ্ল্যাট-গাড়ি-প্লটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন-এ প্রশ্ন রাজউকের অনেকের।

ওই অভিযোগ থেকে জানা যায়, ধনাঢ্যজন হিসেবে রাজউকে ব্যাপক পরিচিতি তিনি। মলি নিজেকে রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের ‘মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’ দাবী করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করেন। অথচ কাগজে-কলমে রাজউক শ্রমিক কর্মচারীলীগে ‘মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’ নামে কোন পদই নাই। মলির ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে দুদকেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে এবং তদন্তও চলছে।

রাজউকের একটি সূত্র বলছে, ‘ফাতেমা বেগম মলি এবং জাহিদুল ইসলাম সবুজের মতো আরও প্রায় কয়েক ডজন কর্মচারী আছেন যারা- গাড়ী-বাড়ি, প্লট-ফ্যাট বনে গেছেন। এদের মধ্যে মো. মোশারফ হোসেন স্কাই, মো. মাহাবুবুর রহমান, মো. জাহাঙ্গীর আলম (কালা জাহাঙ্গীর), এ বি এম কাইয়ুম, মো. নজরুল ইসলাম (অনিয়মিত), মো. আনোয়ার হোসেন আলম, এস এম আব্দুল ওয়াহাব, মো. আবু শাহীন মঞ্জু, মো. ইব্রাহীম, মো. সেলিম রেজা (অনিয়মিত), মো. মহিউদ্দীন মাস্টার, মো. ওহিদুল হাবিব মীনা, মো. পলাশ খান, মো. রোমাজ্জল হোসেন খান, মো. নাদের সরকার, মো. শরীফ উদ্দিন, কে এম রোকনুজ্জামান (অনিয়মিত), মো. রোকন সিরাজী (অনিয়মিত), মো. জাকির হোসেন, আবু জোহায়েত মুরাদ, মো. হেলাল উদ্দিন (অনিয়মিত), সুজন কুমার ভৌমিক উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি রাজউকের সার্ভার হ্যাকড হয়ে ৩০ হাজার নথি গায়েবের ঘটনায় উল্লেখিতদের অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন বলেও ধারণা সূত্রটির।’

এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একাধিক কর্মচারি এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ঘটনা সত্য। যাদের নাম উঠেছে তারা সবাই কোন না কোনভাবে জড়িত। এদের অনেক ক্ষমতাও প্রচুর। তাদের কেউই কিছু করতে পারে না। এজন্য তাদের যা ইচ্ছে হয় তাই করে এই রাজউকে।

এই বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম সবুজের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বিষয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মিথ্যা-বানোয়াট। আমি কাজের বিনিময়ে কোন ঘুষ কারো কাছে দাবি করি না। একটি চক্র আমার পিছনে লেগেছেন।’

এই বিষয়ে ফাতেমা বেগম মলির মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন সদুত্তর দেয়নি।

এই বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হবে। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন রাজউকের সবুজ-মলি!

আপডেট : ০৫:৪২:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩

অনেকের কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য এবং নিছক গল্প মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- রাজউকে চাকরি মানেই যেন সোনার ডিমপাড়া হাঁস কিংবা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাওয়ার সমান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নামক সরকারী। এই প্রতিষ্ঠানকে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রীতিমতো ‘টাকা তৈরীর কারখানায়’ পরিণত করেছে। এখানে টাকা আয়ের বিষয়ে ‘পদ-পদবী’ কোন বাধাই নয়। সম্প্রতি রাজউকের দুই কর্মচারীর নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগের কপি এ প্রতিবেদকের হাতে পৌঁছেছে।

২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর মো. আমিনুল ইসলাম নামে জনৈক ব্যক্তি রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর জাহিদুল ইসলাম সবুজের নামে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজউকের সর্বস্তরের কর্মচারীদের পক্ষে একই ব্যক্তির নামে দুদকে লিখিত আবেদন করেন জনৈক মো. হেলাল উদ্দীন। আবেদনকারী ভিন্ন হলেও অভিযুক্তের বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগের ধরণ একই।অভিযোগ মতে, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের কার্যকরী সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সবুজ। কোটি কোটি টাকার মালিক!

সরকারী স্কেল অনুযায়ী মাত্র ২৫/৩০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী হয়েও কীভাবে এবং কোন উপায়ে তিনি এতো টাকার মালিক হলেন- তা বোধগম্য নয়। উল্লেখিত ব্যক্তি রাজউকে কোনকিছুরই তোয়াক্কা করেন না, নিজের খেয়াল-খুশিমতো অফিস করেন তিনি। অফিসের কাজ ফেলে অধিকাংশ সময়েই বিভিন্ন ফাইলের দালালীতে ব্যস্ত থাকেন। সবুজের তদবীরকৃত ফাইলে স্বাক্ষর না করলে কর্মকর্তাদের নানা রকমের হুমকিসহ তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল ও শারিরিক নির্যাতন করেন বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে সবুজের বিরুদ্ধে।

অভিযোগে আরও জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে রাজউকে যোগদানের পর থেকেই নানা অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ সবুজের বিরুদ্ধে। গত পাঁচ বছর রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখায় থেকে ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি, গড়েছেন বাড়ি-গাড়ি সম্পদের পাহাড়! দাপটের সাথে অনিয়ম-দুর্নীতি করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে সবুজ। বর্তমানে উচ্চমান সহকারী হিসেবে (অ. দা.) দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর গনমাধ্যমে প্রকাশিত ‘‘ঘুষের ওপেন হার্ট রাজউক: প্রভাবশালীদের পেছনে রাজনীতির শক্ত খুঁটি” প্রতিবেদনে উল্লেখিত ‘৪২১’ নম্বর কক্ষটিতেই বসেন জাহিদুল ইসলাম সবুজ। এই কক্ষেই ঘুষের যাবতীয় লেনদেন হয়ে থাকে সবুজের মধ্যস্থতায়। ফাইলের নথি গায়েব থেকে শুরু করে এক প্লট একাধিকজনের কাছে বিক্রি কিংবা প্যাকেজ ঘুষ, সব জায়গায় সবুজের ক্যারিশমাটিক ছোঁয়া আছে। রাজউকে ঘুষখোর এবং ধুরন্ধর কর্মচারীদের একজন হচ্ছেন- জাহিদুল ইসলাম সবুজ এস্টেট ও ভূমি-২ শাখায় ঘুষ লেনদেনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সবুজ। ঘুষের টাকায় রাজধানী মাদারটেক কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় ১০ কাঠা জমিতে বেজমেন্টসহ নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনে একাধিক শেয়ার কিনেছেন সবুজ।

গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বগুড়া শেরপুরেও বাড়ি করেছেন। সবুজের একটি নোহা ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাস আছে যার নম্বর ঢাকা মেট্রো- ৫১৮৯৩৭। এছাড়াও গাজীপুর জেলার ভবানীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে সংলগ্ন “রাজেন্দ্র ইকো রিসো অ্যান্ড ভিলেজ” নামে ৪ তলার অত্যাধুনিক ভবনের শেয়ারহোল্ডার জাহিদুল ইসলাম সবুজ। প্রায় প্রতিরাতেই বিভিন্ন বয়সী নারীদের অশ্লীল নৃত্য আর মদের আসর বসে ওই রিসোর্টে। সেই আসরের নিয়মিত মেহমান জাহিদুল ইসলাম সবুজ। রাজউকের সামান্য বেতনের একজন কর্মচারী হয়েও রাজকীয় জীবন-যাপন করেন তিনি। কাকরাইলে অবস্থিত ‘হোটেল রাজমণি’ ‘ঈশাখা’সহ রাজধানীর অভিজাত এলাকার ‘নামীদামী’ সব ক্লাব ও বারগুলোতে নিয়মিত মদপান ও নর্তকী নিয়ে নাচানাচি করেন সবুজ। মাতাল হয়ে নর্তকীদের শরীরে দু’হাতে টাকা ছিটানো তার প্রতিদিনের নেশা।

ফাতেমা বেগম মলি: অপরদিকে রাজউক জোন-৫ এর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও উচ্চমান সহকারী (অ. দা.) ফাতেমা বেগম মলির স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন মেহেদী হাসান নামের জনৈক ভুক্তভোগী। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দাখিলকৃত ওই অভিযোগে বলা হয়, দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে রাজউকের ঠিকাদারদের জিম্মি করে রেখেছেন মলি।

প্রাক্কলন, চুক্তিপত্র, বোর্ড সভার কর্মপত্র, ঠিকাদারদের বিল এবং প্ল্যান পাসের নথিসহ কোন ফাইলই টাকা ছাড়া ছাড়েন না। মলির অনিয়ম দুর্নীতির কারনে ঠিকানার ও গ্রাহক হয়রানি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার মালিক ফাতেমা বেগম মলি। রাজধানীর পূর্বাচলে ১৭নং সেক্টরে ৫ কাঠার একটি প্লট, ২২ নং সেক্টরে ৫ কাঠার একটি এবং ২৭ নং সেক্টরে ৫ কাঠার আরও একটি প্লটের মালিক মলি। রাজধানীর ঝিগাতলায় ১৫/এ, ডার্লি পয়েন্টে, হাফিজুল্লাহ গ্রীণ টাওয়ারে (লেভেল ই-৫) কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ৩টি ফ্ল্যাট আছে মলির। এছাড়া নারায়ণগঞ্জসহ মলির গ্রামের বাড়ি চাঁদপরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দামী নোহা গাড়ীতে (ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৬১৮) চড়ে অফিসে আসেন তিনি। একজন উচ্চমান সহকারি কীভাবে ফ্ল্যাট-গাড়ি-প্লটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন-এ প্রশ্ন রাজউকের অনেকের।

ওই অভিযোগ থেকে জানা যায়, ধনাঢ্যজন হিসেবে রাজউকে ব্যাপক পরিচিতি তিনি। মলি নিজেকে রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের ‘মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’ দাবী করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করেন। অথচ কাগজে-কলমে রাজউক শ্রমিক কর্মচারীলীগে ‘মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’ নামে কোন পদই নাই। মলির ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে দুদকেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে এবং তদন্তও চলছে।

রাজউকের একটি সূত্র বলছে, ‘ফাতেমা বেগম মলি এবং জাহিদুল ইসলাম সবুজের মতো আরও প্রায় কয়েক ডজন কর্মচারী আছেন যারা- গাড়ী-বাড়ি, প্লট-ফ্যাট বনে গেছেন। এদের মধ্যে মো. মোশারফ হোসেন স্কাই, মো. মাহাবুবুর রহমান, মো. জাহাঙ্গীর আলম (কালা জাহাঙ্গীর), এ বি এম কাইয়ুম, মো. নজরুল ইসলাম (অনিয়মিত), মো. আনোয়ার হোসেন আলম, এস এম আব্দুল ওয়াহাব, মো. আবু শাহীন মঞ্জু, মো. ইব্রাহীম, মো. সেলিম রেজা (অনিয়মিত), মো. মহিউদ্দীন মাস্টার, মো. ওহিদুল হাবিব মীনা, মো. পলাশ খান, মো. রোমাজ্জল হোসেন খান, মো. নাদের সরকার, মো. শরীফ উদ্দিন, কে এম রোকনুজ্জামান (অনিয়মিত), মো. রোকন সিরাজী (অনিয়মিত), মো. জাকির হোসেন, আবু জোহায়েত মুরাদ, মো. হেলাল উদ্দিন (অনিয়মিত), সুজন কুমার ভৌমিক উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি রাজউকের সার্ভার হ্যাকড হয়ে ৩০ হাজার নথি গায়েবের ঘটনায় উল্লেখিতদের অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন বলেও ধারণা সূত্রটির।’

এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একাধিক কর্মচারি এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ঘটনা সত্য। যাদের নাম উঠেছে তারা সবাই কোন না কোনভাবে জড়িত। এদের অনেক ক্ষমতাও প্রচুর। তাদের কেউই কিছু করতে পারে না। এজন্য তাদের যা ইচ্ছে হয় তাই করে এই রাজউকে।

এই বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম সবুজের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বিষয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মিথ্যা-বানোয়াট। আমি কাজের বিনিময়ে কোন ঘুষ কারো কাছে দাবি করি না। একটি চক্র আমার পিছনে লেগেছেন।’

এই বিষয়ে ফাতেমা বেগম মলির মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন সদুত্তর দেয়নি।

এই বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হবে। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে।