ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন পূরণ করবে

মো. রফিকুল ইসলাম
  • আপডেট : ০২:৫৫:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ এপ্রিল ২০২২
  • / 740

বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে একটি উন্নত, বিজ্ঞানমনস্ক সমৃদ্ধি বাংলাদেশকে বোঝায়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ, যা প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি বাংলাদেশের জনগণের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। এবং সব মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথিকৃৎ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা, তিনি পথিকৃৎ হিসেবে লক্ষ্য অর্জনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম জাতীয় অঙ্গীকার হচ্ছে ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে দেশ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বস্তুত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করবে।

১২ ডিসেম্বর, ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষণা করে যে ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বা সৃজনশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার প্লাটফরম রচনা করবে সেটিও সরকার ভাবছে। সরকার দেশটিকে ডিজিটাল বিপ্লব, সৃজনশীল অর্থনীতি, মেধাভিত্তিক শিল্পযুগ বা সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্তত তিনটি সময়কালের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ডিজিটাল শিল্পযুগের ৫টি প্রযুক্তির কৌশলপত্র প্রণীত হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০২০ সালের মুজিব বর্ষ, ২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ২০৩০ সালের এসডিজি, ৪১ সালের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের লক্ষ্য পূরণ এবং ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনার পথে এগিয়ে যাওয়া। ২০২১-২৩ সালের মাঝে ফাইভ-জী চালু করা। দেশের প্রতিটি মানুষকে ফোর জী আওতায় আনা। ফাইভ জির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রেবোটিক্স, বিগ ডাটা, ব্লক চেইন, আইওটিসহ ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো। ই পাসপোর্ট এবং ই-ভিসা চালু করা । সরকারের সকল অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পূর্ণ ডিজিটাল রূপান্তর করা ও সরকারের সকল সেবা জনগণের হাতের নাগালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পৌঁছানো।

ডিজিটাল অপরাধ দমনে ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটির প্রয়োগও করা হচ্ছে। এর সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি স্থাপিত হয়েছে । মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এর প্রকৃতি নির্ধারণের পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। হাইটেক পার্ক, বিসিসি, বিআইটিএম, এলআইসিটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রশিক্ষণ দিয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানব সম্পদে পরিণত করা হয়েছে ও কর্মসংস্থান করা হয়েছে। এটি এখন সরকারের অব্যাহত চলমান প্রক্রিয়া। শিল্পখাতকে কর সহায়তা ও নগদ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে।

মোবাইল ফোনের বাজারের শতকরা ৫২ ভাগ দেশে উৎপাদিত হয়। মোবাইল ও ল্যাপটপ রপ্তানি হচ্ছে । ডিজিটাল-কমার্স নীতিমালা ১৮, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮ ও জাতীয় টেলিকম নীতিমালা ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি গাইডলাইন, সিগনিফিকেন্ট মার্কেট প্লেয়ার গাইডলাইন, ইনফ্রাস্ট্রাকচার গাইডলাইন, কোয়ালিটি অভ সার্ভিস গাইডলাইন, আইএসপিএবি গাইডলাইন প্রণীত হয়েছে। টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর অনুসারে টাওয়ার তৈরি শুরু হয়েছে। ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার চালু হয়েছে। সি-মি-উই-৬ এর সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রকল্পটিও অনুমোদিত হয়েছে। ২০২৪ সালে সেটি চালু হবে।

কার্যত এ দেশের মানুষের জীবনযাপন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি, শিল্প-বাণিজ্য ও উৎপাদন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা এবং জনগণের সরকারসহ সব স্তরের সকল কাজকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করা। ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে জনগণের উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন, মৌলিক মানবিক অধিকার সংরক্ষণ, সকল সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে। ‘দরিদ্র জনগণকে জ্ঞানকর্মী বা ডিজিটাল প্রযুক্তিকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং গ্রামে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-বাণিজ্যসহ কৃষি, শিক্ষা, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’

রাজনৈতিক ধারা: ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো সরকার, জাতীয় সংসদসহ সব

২. রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থা ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালনা করা, যাতে জনগণ সব সময়ই সংসদ, সরকার ও রাজনীতিতে ইন্টার অ্যাকটিভ পদ্ধতিতে অংশ নিতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সরকারের কাজ করার পদ্ধতি ডিজিটাল করা, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো, ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রচলন করা, তথ্যের অবাধ চলাচলের জন্য ডিজিটাল-ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণাই নয়, এর সফলতাও অনেক রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার প্রথম বছরে দৃঢ়তার সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে এর ভিত্তি বা প্রথম সোপান। সরকার আইসিটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে, সেটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ, ই-কমার্স চালু করা, নতুন নতুন প্রযুক্তির লাইসেন্স প্রদান করা, সরকারের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে।

তারহীন উচ্চগতির ইন্টারনেট ওয়াইম্যাক্স সহজলভ্য হোক এবং সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এই সবার প্রত্যাশা। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। আমরা যদি গ্রামের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ পদার্পনে অর্থ ও শারীরিক শক্তির বদলে মেধা ও জ্ঞানের শক্তির প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ থেকে বাংলাদেশ একটি সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়ে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেবে। আর এই স্বপ্ন পূরণের জন্য সরকার ও জনগণকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে হচ্ছে, ‘‘তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে সুশাসন থাকবে, সরকারের কার্যক্রমে দায়বদ্ধতা-স্বচ্ছতা থাকবে, দুর্নীতি কমে যাবে।

ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াটি এমন, যার মাধ্যমে দেশের নাগরিকরা অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম করতে পারছেন। আমেরিকায় অবস্থানরত ছেলের সাথে মা বাংলাদেশে বসে কথা বলছেন। নিজের চোখে ছেলেকে দেখবেন। ক্ষেতের কৃষক তার ফসলের অবস্থা জেলা কৃষি কর্মকর্তাকে দেখিয়েছে সমাধান করছেন। কোনো পোকার ওষুধ কি দিবেন, বলে দিচ্ছেন। কারও কোথাও যাওয়া লাগবে না।

দেড় শতাধিক সরকারি ফরম এখন অনলাইনে পাওয়া যায় এবং তথ্য পূরণ করে অনলাইনেই তা সাবমিট করা যায়। অনলাইনে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিবিৎসাসহ নানা ধরণের নাগরিক সেবা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকলেও দাপ্তরিক কাজের কোনো ক্ষতি বা সময় ক্ষেপন হয় না। অনলাইনে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এখন কোনো কাগজই ব্যবহার করে না, ই-ফাইলিং এর মাধ্যমে অফিসের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে।

দেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়ায় আধা-সরকারি ও বেসরকারি খাতও ভূমিকা রাখছে। অললাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, অনলাইন শপিং বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন অনলাইন চিকিৎসা পরামর্শ, টেলিমেডিসিন, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকার এখন অনলাইনে ২১০০ ধরণের সেবা দিচ্ছে। দেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়ায় আধা-সরকারি ও বেসরকারি খাতও ভূমিকা রাখছে। অললাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, অনলাইন শপিং বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন, ফল, ভর্তি সব কিছুই অনলাইনে হচ্ছে। এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশ।

সরকারের সচিবসহ বিভিন্ন দপ্তর এবং অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রায়ই তাঁদের অধীনস্থদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন। দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের প্রত্যেকের একটি করে ফেসবুক পেজ আছে। তারা সেখানে সাধারণ মানুষের কথা শোনেন। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেন। এছাড়া সরকারের নীতি নির্ধারক ও নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের একটি ‘ক্লোজড ফেসবুক গ্রুপ’ আছে। সেখানে তাঁরা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রী দেশের জেলা প্রশাসকসহ নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি ডিজিটালি যুক্ত আছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থাসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প কাজ করছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়াই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। ইতোমধ্যেই সেই লক্ষ্যে অনেকটাই সফল সরকার। প্রত্যাশা করি অদূর ভবিষ্যতে ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পৌছে যাব আমরা।

লেখক:গণসংযোগ কর্মকর্তা শিল্প মন্ত্রণালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন পূরণ করবে

আপডেট : ০২:৫৫:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ এপ্রিল ২০২২

বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে একটি উন্নত, বিজ্ঞানমনস্ক সমৃদ্ধি বাংলাদেশকে বোঝায়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ, যা প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি বাংলাদেশের জনগণের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। এবং সব মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথিকৃৎ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা, তিনি পথিকৃৎ হিসেবে লক্ষ্য অর্জনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম জাতীয় অঙ্গীকার হচ্ছে ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে দেশ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বস্তুত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করবে।

১২ ডিসেম্বর, ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষণা করে যে ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বা সৃজনশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার প্লাটফরম রচনা করবে সেটিও সরকার ভাবছে। সরকার দেশটিকে ডিজিটাল বিপ্লব, সৃজনশীল অর্থনীতি, মেধাভিত্তিক শিল্পযুগ বা সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্তত তিনটি সময়কালের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ডিজিটাল শিল্পযুগের ৫টি প্রযুক্তির কৌশলপত্র প্রণীত হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০২০ সালের মুজিব বর্ষ, ২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ২০৩০ সালের এসডিজি, ৪১ সালের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের লক্ষ্য পূরণ এবং ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনার পথে এগিয়ে যাওয়া। ২০২১-২৩ সালের মাঝে ফাইভ-জী চালু করা। দেশের প্রতিটি মানুষকে ফোর জী আওতায় আনা। ফাইভ জির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রেবোটিক্স, বিগ ডাটা, ব্লক চেইন, আইওটিসহ ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো। ই পাসপোর্ট এবং ই-ভিসা চালু করা । সরকারের সকল অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পূর্ণ ডিজিটাল রূপান্তর করা ও সরকারের সকল সেবা জনগণের হাতের নাগালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পৌঁছানো।

ডিজিটাল অপরাধ দমনে ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটির প্রয়োগও করা হচ্ছে। এর সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি স্থাপিত হয়েছে । মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এর প্রকৃতি নির্ধারণের পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। হাইটেক পার্ক, বিসিসি, বিআইটিএম, এলআইসিটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রশিক্ষণ দিয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানব সম্পদে পরিণত করা হয়েছে ও কর্মসংস্থান করা হয়েছে। এটি এখন সরকারের অব্যাহত চলমান প্রক্রিয়া। শিল্পখাতকে কর সহায়তা ও নগদ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে।

মোবাইল ফোনের বাজারের শতকরা ৫২ ভাগ দেশে উৎপাদিত হয়। মোবাইল ও ল্যাপটপ রপ্তানি হচ্ছে । ডিজিটাল-কমার্স নীতিমালা ১৮, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮ ও জাতীয় টেলিকম নীতিমালা ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি গাইডলাইন, সিগনিফিকেন্ট মার্কেট প্লেয়ার গাইডলাইন, ইনফ্রাস্ট্রাকচার গাইডলাইন, কোয়ালিটি অভ সার্ভিস গাইডলাইন, আইএসপিএবি গাইডলাইন প্রণীত হয়েছে। টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর অনুসারে টাওয়ার তৈরি শুরু হয়েছে। ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার চালু হয়েছে। সি-মি-উই-৬ এর সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রকল্পটিও অনুমোদিত হয়েছে। ২০২৪ সালে সেটি চালু হবে।

কার্যত এ দেশের মানুষের জীবনযাপন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি, শিল্প-বাণিজ্য ও উৎপাদন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা এবং জনগণের সরকারসহ সব স্তরের সকল কাজকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করা। ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে জনগণের উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন, মৌলিক মানবিক অধিকার সংরক্ষণ, সকল সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে। ‘দরিদ্র জনগণকে জ্ঞানকর্মী বা ডিজিটাল প্রযুক্তিকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং গ্রামে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-বাণিজ্যসহ কৃষি, শিক্ষা, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’

রাজনৈতিক ধারা: ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো সরকার, জাতীয় সংসদসহ সব

২. রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থা ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালনা করা, যাতে জনগণ সব সময়ই সংসদ, সরকার ও রাজনীতিতে ইন্টার অ্যাকটিভ পদ্ধতিতে অংশ নিতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সরকারের কাজ করার পদ্ধতি ডিজিটাল করা, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো, ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর, যোগাযোগ ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রচলন করা, তথ্যের অবাধ চলাচলের জন্য ডিজিটাল-ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণাই নয়, এর সফলতাও অনেক রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার প্রথম বছরে দৃঢ়তার সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে এর ভিত্তি বা প্রথম সোপান। সরকার আইসিটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে, সেটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ, ই-কমার্স চালু করা, নতুন নতুন প্রযুক্তির লাইসেন্স প্রদান করা, সরকারের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে।

তারহীন উচ্চগতির ইন্টারনেট ওয়াইম্যাক্স সহজলভ্য হোক এবং সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এই সবার প্রত্যাশা। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। আমরা যদি গ্রামের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ পদার্পনে অর্থ ও শারীরিক শক্তির বদলে মেধা ও জ্ঞানের শক্তির প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ থেকে বাংলাদেশ একটি সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়ে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেবে। আর এই স্বপ্ন পূরণের জন্য সরকার ও জনগণকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে হচ্ছে, ‘‘তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে সুশাসন থাকবে, সরকারের কার্যক্রমে দায়বদ্ধতা-স্বচ্ছতা থাকবে, দুর্নীতি কমে যাবে।

ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াটি এমন, যার মাধ্যমে দেশের নাগরিকরা অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম করতে পারছেন। আমেরিকায় অবস্থানরত ছেলের সাথে মা বাংলাদেশে বসে কথা বলছেন। নিজের চোখে ছেলেকে দেখবেন। ক্ষেতের কৃষক তার ফসলের অবস্থা জেলা কৃষি কর্মকর্তাকে দেখিয়েছে সমাধান করছেন। কোনো পোকার ওষুধ কি দিবেন, বলে দিচ্ছেন। কারও কোথাও যাওয়া লাগবে না।

দেড় শতাধিক সরকারি ফরম এখন অনলাইনে পাওয়া যায় এবং তথ্য পূরণ করে অনলাইনেই তা সাবমিট করা যায়। অনলাইনে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিবিৎসাসহ নানা ধরণের নাগরিক সেবা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকলেও দাপ্তরিক কাজের কোনো ক্ষতি বা সময় ক্ষেপন হয় না। অনলাইনে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এখন কোনো কাগজই ব্যবহার করে না, ই-ফাইলিং এর মাধ্যমে অফিসের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে।

দেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়ায় আধা-সরকারি ও বেসরকারি খাতও ভূমিকা রাখছে। অললাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, অনলাইন শপিং বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন অনলাইন চিকিৎসা পরামর্শ, টেলিমেডিসিন, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকার এখন অনলাইনে ২১০০ ধরণের সেবা দিচ্ছে। দেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়ায় আধা-সরকারি ও বেসরকারি খাতও ভূমিকা রাখছে। অললাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, অনলাইন শপিং বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন, ফল, ভর্তি সব কিছুই অনলাইনে হচ্ছে। এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশ।

সরকারের সচিবসহ বিভিন্ন দপ্তর এবং অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রায়ই তাঁদের অধীনস্থদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন। দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের প্রত্যেকের একটি করে ফেসবুক পেজ আছে। তারা সেখানে সাধারণ মানুষের কথা শোনেন। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেন। এছাড়া সরকারের নীতি নির্ধারক ও নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের একটি ‘ক্লোজড ফেসবুক গ্রুপ’ আছে। সেখানে তাঁরা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রী দেশের জেলা প্রশাসকসহ নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি ডিজিটালি যুক্ত আছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থাসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প কাজ করছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়াই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। ইতোমধ্যেই সেই লক্ষ্যে অনেকটাই সফল সরকার। প্রত্যাশা করি অদূর ভবিষ্যতে ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পৌছে যাব আমরা।

লেখক:গণসংযোগ কর্মকর্তা শিল্প মন্ত্রণালয়