তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও প্রতিবন্ধকতা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট : ১১:৫৫:৪৩ পূর্বাহ্ন, সোমাবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১
  • / 450

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার। যা বর্তমানে করোনা সংক্রমণের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। মানুষের শরীরে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কাজ করে ধীরে ধীরে। যে কারণে তাৎক্ষনিকভাবে আমাদের মনোজগতে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি’র ‘দ্য ইকোনমিক কষ্ট অফ টোবাকো ইউজ ইন বাংলাদেশঃ ‘হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যা সেই বছরের মোট মৃত্যুর ১৩.৫%।

একই বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগেছে এবং প্রায় ৬২ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৮ হাজার ৪শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৬% খরচ বহন করেছে ব্যবহারকারীর পরিবার আর ২৪% মেটানো হয়েছে জনস্বাস্থ্যের বাজেট থেকে।

তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা ও এর কারণে অকালমৃত্যুর ফলে বার্ষিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় প্রায় ২২ হাজার ২শ কোটি টাকা। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিলো ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, এর বিপরিতে ২০১৮ সালের দামের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে তামাক খাতের অবদান ছিলো ২২ হাজার ৯শ কোটি টাকা।

এই খাতে অর্থনৈতিক ব্যয়ের চেয়ে আয় কম হয়েছে ৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই তথ্যকে পাশ কাটিয়ে তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তো প্রচার করা হয় তারা সর্বোচ্চ করদাতা। পরিতাপের বিষয় এই কর প্রাপ্তির মাশুল হিসাবে সরকারকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় মেটাতে হয়, কতো মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে!

বাংলাদেশে এমন দ্বিতীয় একটি বেসরকারী খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না যার আয়করের জন্য উল্টো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়, জনস্বাস্থ্য মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন ক্ষতিকে মেনে নিয়ে এ খাতকে যারা বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে, এর পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করে,তারা ‘রূপকল্প ২০৪১’ কে নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত করতে চায়। কারণ জনস্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ‘ভিশন বাংলাদেশ ২০৪১’ অর্জন একটি অসম্ভব ব্যাপার সেটা বোঝার জন্য জ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই!

তামাক কোম্পানি প্রশ্ন উত্থাপন করছে, তামাক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কেনো সম্পৃক্ত হচ্ছে!! স্থানীয় সরকার (পৌরসভা/ সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুসারে নাগরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রকাশ করেছে।

গাইডলাইনের ধারা ৮.১ অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হয়েছে বিক্রয় সীমিতকরণের লক্ষ্যে। এই লাইসেন্সিং ব্যবস্থাটি তামাক কোম্পানির গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছে। ব্যবস্থাটিকে বানচালের জন্য তারা একের পর এক অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।

একটি বিতর্ক তামাক কোম্পানি তাদের পেইড বেনিফিসিয়ারিদের মাধ্যমে উত্থাপন করছে, লাইসেন্স দেওয়ার অর্থ বৈধতা দেওয়া। আচ্ছা বলুনতো, বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কী অবৈধ? যদি অবৈধ না হয়ে থাকে তবে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার আওতায় আনার মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নটি কী একেবারেই অবান্তর নয়!! যে বিষয়টি সামনে আসছে সেটি হলো তামাকজাত দ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রয়কে নিয়ন্ত্রিত করা। যাতে এর ব্যবহার কমে আসে। এটাই এখন তামাক কোম্পানির জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।

তামাক কোম্পানি তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবিদের মাধ্যমে বলাচ্ছে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি লাইসেন্স বোঝা চাপিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলবে। এটাও বলছে, সরকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

স্বল্প আয়ের মানুষদের কী একমাত্র বিক্রয় পণ্য তামাকাকজাত দ্রব্য? বিড়ি-সিগারেট-জর্দা-গুল বিক্রয়ের পরিবর্তে স্বল্প পুঁজিতে কী তার পক্ষে আর কোন দ্রব্য বিক্রয় করা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। কারণ দেশের সমস্ত স্বল্প আয়ের মানুষ যারা ব্যবসা করে তারা সবাই তো তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করেনা! তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় না করে এ সমস্ত প্রান্তিক মানুষরা খাদ্যদ্রব্য অথবা নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য এমন আরো অনেক কিছু নিয়েই হকারী করে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে।

যাদের হোল্ডিং নাম্বার নেই তারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে পারবেনা। সরকারতো তাকে অন্যকিছু বিক্রয় করতে নিষেধ করছেনা। এর জন্য লাইসেন্সও নিতে বলছেনা। তামাকজাত দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রয় করলেই তো কোন সমস্যা থাকছেনা। বিষয়টি কোনভাবেই অনানুষ্ঠানিক খাতকে জোর করে আনুষ্ঠানিক খাতে আনার বিষয় নয়। সমস্যাটি স্বল্প আয়ের মানুষদের বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের না, সমস্যা হবে তামাক কোম্পানির। কারণ তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের বিক্রি কমে যাবে। ফলশ্রæতিতে উৎপাদনও কমে আসবে।

সরকার সেটাই চাইছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণা বাস্তবায়ন করার জন্য নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমেই ব্যবহার-উৎপাদন এভাবেই কমিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশে এমন অনেক ব্যবসা আছে যার জন্য দ্বৈত লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে যাদের হোল্ডিং নাম্বার আছে এবং তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা ছাড়া যদি তাদের না চলে, তারা লাইসেন্স ব্যবহার করে ব্যবসা করবে। যাদের দুটি লাইসেন্স করার সামর্থ্য নেই তামাকজাত দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রয় করবে।

সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কর তফসিল পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখবো, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাকজাত দ্রব্যের কোম্পানির লাইসেন্স ফি ৫ হাজার টাকা, এজেন্টের ৫ হাজার টাকা, খুচরা বিক্রেতার ৫শ-৩শ টাকা। অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতালের জন্য ৩৫ হাজার টাকা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৭ হাজার ৫শ টাকা, হেলথ ক্লাব ৫ হাজার টাকা।

তুলনামূলক বিচার করে দেখুন, এদের মধ্যে সবচেয়ে আয় বেশি তামাক কোম্পানির। এবং লাইসেন্স ফি সবচেয়ে কমও তাদের। অথচ স্বাস্থ্য-শিক্ষা-শরীর চর্চা যা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে তাদের লাইসেন্স ফি বেশি। অন্যদিকে যাদের কারণে জনস্বাস্থ্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের ফি কম!! প্রকৃতপক্ষে দেশের অন্য সবকিছুর তুলনায় তামাক কোম্পানির লাইসেন্স ফি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি, নয় কী?

২০৪০ হতে বাকি মাত্র ১৮ বছর! যারা তামাক কোম্পানির পক্ষে এখনো ওকালতি করেন, জানতে ইচ্ছা করে, আপনারা কী স্বপ্ন দেখেন ২০৪০ সালে এসেও বাংলাদেশে তামাক কোম্পানি সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে থাকবে?? যদি এই স্বপ্ন দেখে থাকেন সেটিতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক! তাহলে ইনিয়ে-বিনিয়ে না বলে জোর গলায় বলুন, ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ এই ঘোষণা আপনারা মানেননা।

যারা লাইসেন্সিং এর বিরোধিতা করছেন স্বল্প আয়ের মানুষদের ক্ষতির বেদনায় বেদনার্ত হয়ে, তাদের প্রতি আহŸান, সত্যিই যদি ব্যথিত হয়ে থাকেন তবে লাইসেন্সিং এর বিরোধিতা না করে বিকল্প অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা দিন। বিশ্বের ইতিহাসে এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসেও যুগে যুগে সময়ের প্রয়োজনে পেশার পরিবর্তন ঘটেছে। এটা অস্বাভাবিক কোন বিষয় না।

দেশে একসময় টাইপরাইটার মেশিনে টাইপিষ্টরা টাইপ করতো, কিন্তু এখন আর এই পেশাটি সেভাবে নেই। যারা এর সাথে যুক্ত ছিলো তারা কী না খেয়ে জীবন-যাপন করছে? আমরা আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি ফেরিওয়ালারা পুরানো জামাকাপড় বদলিয়ে হাড়ি-পাতিল দিতো, এদের কেউ এখন দেখা যায়না, এরাও কী জীবিকা ছাড়া রয়েছে? এভাবেই সময়ের প্রয়োজনে পেশা পরিবর্তন হয়ে যায়! আমাদের সকলের উচিত বিকল্প চিন্তা করা।

স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন অনুসারে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর বিরোধীতা আর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিরোধীতা সমার্থক। আগামী প্রজন্মকে তামাকের নীল থাবার দিকে ঠেলে দেওয়া।

উন্নয়ন কর্মী–

আবু নাসের অনীক

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও প্রতিবন্ধকতা

আপডেট : ১১:৫৫:৪৩ পূর্বাহ্ন, সোমাবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার। যা বর্তমানে করোনা সংক্রমণের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। মানুষের শরীরে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কাজ করে ধীরে ধীরে। যে কারণে তাৎক্ষনিকভাবে আমাদের মনোজগতে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি’র ‘দ্য ইকোনমিক কষ্ট অফ টোবাকো ইউজ ইন বাংলাদেশঃ ‘হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যা সেই বছরের মোট মৃত্যুর ১৩.৫%।

একই বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগেছে এবং প্রায় ৬২ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৮ হাজার ৪শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৬% খরচ বহন করেছে ব্যবহারকারীর পরিবার আর ২৪% মেটানো হয়েছে জনস্বাস্থ্যের বাজেট থেকে।

তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা ও এর কারণে অকালমৃত্যুর ফলে বার্ষিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় প্রায় ২২ হাজার ২শ কোটি টাকা। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিলো ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, এর বিপরিতে ২০১৮ সালের দামের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে তামাক খাতের অবদান ছিলো ২২ হাজার ৯শ কোটি টাকা।

এই খাতে অর্থনৈতিক ব্যয়ের চেয়ে আয় কম হয়েছে ৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই তথ্যকে পাশ কাটিয়ে তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তো প্রচার করা হয় তারা সর্বোচ্চ করদাতা। পরিতাপের বিষয় এই কর প্রাপ্তির মাশুল হিসাবে সরকারকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় মেটাতে হয়, কতো মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে!

বাংলাদেশে এমন দ্বিতীয় একটি বেসরকারী খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না যার আয়করের জন্য উল্টো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়, জনস্বাস্থ্য মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন ক্ষতিকে মেনে নিয়ে এ খাতকে যারা বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে, এর পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করে,তারা ‘রূপকল্প ২০৪১’ কে নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত করতে চায়। কারণ জনস্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ‘ভিশন বাংলাদেশ ২০৪১’ অর্জন একটি অসম্ভব ব্যাপার সেটা বোঝার জন্য জ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই!

তামাক কোম্পানি প্রশ্ন উত্থাপন করছে, তামাক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কেনো সম্পৃক্ত হচ্ছে!! স্থানীয় সরকার (পৌরসভা/ সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুসারে নাগরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রকাশ করেছে।

গাইডলাইনের ধারা ৮.১ অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হয়েছে বিক্রয় সীমিতকরণের লক্ষ্যে। এই লাইসেন্সিং ব্যবস্থাটি তামাক কোম্পানির গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছে। ব্যবস্থাটিকে বানচালের জন্য তারা একের পর এক অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।

একটি বিতর্ক তামাক কোম্পানি তাদের পেইড বেনিফিসিয়ারিদের মাধ্যমে উত্থাপন করছে, লাইসেন্স দেওয়ার অর্থ বৈধতা দেওয়া। আচ্ছা বলুনতো, বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কী অবৈধ? যদি অবৈধ না হয়ে থাকে তবে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার আওতায় আনার মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নটি কী একেবারেই অবান্তর নয়!! যে বিষয়টি সামনে আসছে সেটি হলো তামাকজাত দ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রয়কে নিয়ন্ত্রিত করা। যাতে এর ব্যবহার কমে আসে। এটাই এখন তামাক কোম্পানির জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।

তামাক কোম্পানি তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবিদের মাধ্যমে বলাচ্ছে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি লাইসেন্স বোঝা চাপিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলবে। এটাও বলছে, সরকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

স্বল্প আয়ের মানুষদের কী একমাত্র বিক্রয় পণ্য তামাকাকজাত দ্রব্য? বিড়ি-সিগারেট-জর্দা-গুল বিক্রয়ের পরিবর্তে স্বল্প পুঁজিতে কী তার পক্ষে আর কোন দ্রব্য বিক্রয় করা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। কারণ দেশের সমস্ত স্বল্প আয়ের মানুষ যারা ব্যবসা করে তারা সবাই তো তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করেনা! তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় না করে এ সমস্ত প্রান্তিক মানুষরা খাদ্যদ্রব্য অথবা নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য এমন আরো অনেক কিছু নিয়েই হকারী করে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে।

যাদের হোল্ডিং নাম্বার নেই তারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে পারবেনা। সরকারতো তাকে অন্যকিছু বিক্রয় করতে নিষেধ করছেনা। এর জন্য লাইসেন্সও নিতে বলছেনা। তামাকজাত দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রয় করলেই তো কোন সমস্যা থাকছেনা। বিষয়টি কোনভাবেই অনানুষ্ঠানিক খাতকে জোর করে আনুষ্ঠানিক খাতে আনার বিষয় নয়। সমস্যাটি স্বল্প আয়ের মানুষদের বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের না, সমস্যা হবে তামাক কোম্পানির। কারণ তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের বিক্রি কমে যাবে। ফলশ্রæতিতে উৎপাদনও কমে আসবে।

সরকার সেটাই চাইছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণা বাস্তবায়ন করার জন্য নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমেই ব্যবহার-উৎপাদন এভাবেই কমিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশে এমন অনেক ব্যবসা আছে যার জন্য দ্বৈত লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে যাদের হোল্ডিং নাম্বার আছে এবং তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা ছাড়া যদি তাদের না চলে, তারা লাইসেন্স ব্যবহার করে ব্যবসা করবে। যাদের দুটি লাইসেন্স করার সামর্থ্য নেই তামাকজাত দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রয় করবে।

সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কর তফসিল পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখবো, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাকজাত দ্রব্যের কোম্পানির লাইসেন্স ফি ৫ হাজার টাকা, এজেন্টের ৫ হাজার টাকা, খুচরা বিক্রেতার ৫শ-৩শ টাকা। অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতালের জন্য ৩৫ হাজার টাকা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৭ হাজার ৫শ টাকা, হেলথ ক্লাব ৫ হাজার টাকা।

তুলনামূলক বিচার করে দেখুন, এদের মধ্যে সবচেয়ে আয় বেশি তামাক কোম্পানির। এবং লাইসেন্স ফি সবচেয়ে কমও তাদের। অথচ স্বাস্থ্য-শিক্ষা-শরীর চর্চা যা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে তাদের লাইসেন্স ফি বেশি। অন্যদিকে যাদের কারণে জনস্বাস্থ্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের ফি কম!! প্রকৃতপক্ষে দেশের অন্য সবকিছুর তুলনায় তামাক কোম্পানির লাইসেন্স ফি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি, নয় কী?

২০৪০ হতে বাকি মাত্র ১৮ বছর! যারা তামাক কোম্পানির পক্ষে এখনো ওকালতি করেন, জানতে ইচ্ছা করে, আপনারা কী স্বপ্ন দেখেন ২০৪০ সালে এসেও বাংলাদেশে তামাক কোম্পানি সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে থাকবে?? যদি এই স্বপ্ন দেখে থাকেন সেটিতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক! তাহলে ইনিয়ে-বিনিয়ে না বলে জোর গলায় বলুন, ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ এই ঘোষণা আপনারা মানেননা।

যারা লাইসেন্সিং এর বিরোধিতা করছেন স্বল্প আয়ের মানুষদের ক্ষতির বেদনায় বেদনার্ত হয়ে, তাদের প্রতি আহŸান, সত্যিই যদি ব্যথিত হয়ে থাকেন তবে লাইসেন্সিং এর বিরোধিতা না করে বিকল্প অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা দিন। বিশ্বের ইতিহাসে এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসেও যুগে যুগে সময়ের প্রয়োজনে পেশার পরিবর্তন ঘটেছে। এটা অস্বাভাবিক কোন বিষয় না।

দেশে একসময় টাইপরাইটার মেশিনে টাইপিষ্টরা টাইপ করতো, কিন্তু এখন আর এই পেশাটি সেভাবে নেই। যারা এর সাথে যুক্ত ছিলো তারা কী না খেয়ে জীবন-যাপন করছে? আমরা আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি ফেরিওয়ালারা পুরানো জামাকাপড় বদলিয়ে হাড়ি-পাতিল দিতো, এদের কেউ এখন দেখা যায়না, এরাও কী জীবিকা ছাড়া রয়েছে? এভাবেই সময়ের প্রয়োজনে পেশা পরিবর্তন হয়ে যায়! আমাদের সকলের উচিত বিকল্প চিন্তা করা।

স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন অনুসারে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর বিরোধীতা আর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিরোধীতা সমার্থক। আগামী প্রজন্মকে তামাকের নীল থাবার দিকে ঠেলে দেওয়া।

উন্নয়ন কর্মী–

আবু নাসের অনীক