সর্বস্বান্ত উপকূলের মাছ চাষিরা
- আপডেট : ০৭:৩৬:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ মে ২০২১
- / 228
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় জেলাগুলোতে সর্বসান্ত হয়েছে লাখ লাখ পরিবার। জোয়ারের পানির তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ভেঙে গেছে ঘরবাড়িসহ গাছপালা। মাছের ঘের ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার। বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে মাছের ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র:
সাতক্ষীরায় ভেসে গেছে ৫৫ কোটি টাকার মাছ:
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিংড়ি চাষিরা। কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও কাকশিয়ালিসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চ জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে সুন্দরবন সংলগ্ন ৪টি উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। প্লাবিত হয় প্রায় ৭ হাজার চিংড়ি ঘের। ভেসে গেছে ৫৫ কোটি টাকার মাছ।
গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াস উপকূলবাসীকে সর্বশান্ত করে গেল। এ অবস্থায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে সুদমুক্ত ঋণ চায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য ও চিংড়ি চাষিরা।
গত ২৬ মে বেলা ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ারে নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় আছড়ে পড়ে সাতক্ষীরা উপকূলে। ততক্ষণে সুন্দরবন সংলগ্ন কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও কালিন্দী নদীর ভাঙনকবলিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৩টি পয়েন্টের ২০ পয়েন্ট ভেঙে যায়।
শতাধিক স্থানে জোয়ারের পানি উপচে পড়ে প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়। হু হু করে মুহূর্তের মধ্যে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে রস্তা-ঘাট খাল-বিল এবং বসতবাড়িসহ প্রায় ৭ হাজার চিংড়ি ঘের তলিয়ে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা। আশাশুনি উপজেলা প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আনুলিয়া, বড়দল ও খাজরা ইউনিয়নের ১৪৫০ হেক্টর জমির ৩ হাজার ৫৬০টি মৎস্য ঘের ভেসে গেছে।
শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর, গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, কৈইখালী, নুরনগর ইউনিয়নের ৯৫০ হেক্টর জমির প্রায় ৩ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। লোনা পানির কারণে এসব অঞ্চলে ফসল ফলে না। কিছু এলাকায় লবণসহিষ্ণু ধান উৎপাদন হলেও জৈষ্ঠ্যের আগেই বৈশাখ মাসে কৃষকদের ঘরে ধান উঠে গেছে। তাই কৃষি পণ্যের কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। এছাড়া কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে কয়েক হাজার মৎস্য ঘের। সর্বশান্ত হয় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিরা
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাব মতে দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ২৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ছোট-বড় ৭ হাজারের মতো মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়েছে। ক্ষক্ষিগ্রস্ত হয়েছে রেণুপোনা ও হ্যাচারি মালিকরা। ভেসে গেছে আনুমানিক ৫৫ কোটি টাকার মাছ।
তিনি আরও জানান, গত বছর আম্পানে চিংড়ি ও মৎস্য চাষিদের যে ক্ষতি হয়েছিল, সেটি কাটিয়ে ওঠার আগেই ইয়াস তাদেরকে সর্বশান্ত করে দিয়েছে। তাই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সল্প সুদে মৎস্য চাষিদের ঋণ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে প্রত্যাশা করেন তিনি। এছাড়া শিগগিরই টেকসই দীর্ঘমেয়াদি বেড়িবাঁধ নির্মাণের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ আবারও প্রকৃতির সাথে লড়াই করে স্বাভাবিক জীবনে ঘুরে দাঁড়াবে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
বাগেরহাটে ভেসে গেছে ৫ হাজার চিংড়ি ঘের:
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের পানির প্রভাবে উপকূলীয় বাগেরহাটে ভেসে গেছে ৫ হাজার চিংড়ি ঘের। এতে জেলার মাছ চাষিদের প্রায় ৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ. এস. এম. রাসেল। বুধবার ও বৃহস্পতিবার জোয়ারের পানিতে এসব মাছের ঘের ভেসে যায়। তবে আজ শুক্রবারও জেলার রামপাল উপজেলায় বেশকিছু ঘের ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বাগেরহাটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলর মাছ চাষিরা। এসব উপজেলার চিংড়ি চাষিরা নেট ও পাটা দিয়ে ঘের রক্ষার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, জোয়ারের পানি আরও বৃদ্ধি পেলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান আরও বৃদ্ধি পাবে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার রামপাল উপজেলায় ৪ হাজার ৮৩৭টি, মোংলায় ৫ হাজার ৬০১টি, শরণখোলায় ১ হাজার ৩৪২টি ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় চিংড়ি ঘের রয়েছে ৯ হাজার ৯২০টি। এর মধ্যে চিংড়ি ও সাদা মাছের ঘের ভেসে গেছে প্রায় ৫ হাজার। জেলায় ৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে ৮১ হাজার ৩৫৮টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। আর চিংড়ি চাষি রয়েছে ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন।
রামপাল উপজেলার হুকরা গ্রামের বাসিন্দা মনোরঞ্জন ঢালি বলেন, পানিতে আমার ১২ বিঘার তিনটি ঘেরের মধ্যে দুটি পুরোপুরি ভেসে যায়। একটি আংশিক ডুবে ছিলো। নেট ও পাটা দিয়ে ঘেরটি রক্ষার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটিও আজ ভেসে গেছে। এতে আমার ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমার মতো অন্যান্য ঘের মালিকও তাদের ঘের রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে জোয়ারের পানির তরে অধিকাংশ ঘেরই ভেসে গেছে।
শরণখোলা উপজেলার তাফালবাড়ী এলাকার মিজান গাজী বলেন, ‘মুই গরীব মানুষ ভাই। এনিজও ও এলেকার বিভিন্ন মানুর কাছ থাইক্কা টাহা-পয়সা ধার দেনা কইরা ৩ বিঘার দুইডা ঘের করছেলাম। এই ঘেরে টাহায় মোর সংসার চলে। মুই তো পথের ফহির হইয়া গেলাম। বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।’ মোরেলগঞ্জের জিউধরা ইউনিয়নের নিশানবাড়ীয়া গ্রামের আফজাল শরীফ বলেন, ‘ভাই মোগো এইহানে এহন আর মোর আর তার নাই, সব এহন সমান। নেট-পাটা দিয়াও ঘের রাখতে পারি নাই, সব ডুইব্বা গেছে। কাইলগোর থাইকা আইজগো পানি আরও বাড়ছে।’
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ. এস. এম. রাসেল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাতাস ও জোয়ারের পানির প্রভাবে জেলার রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার প্রায় ৫ হাজার চিংড়ি ও সাদা মাছের ঘের ভেসে গেছে। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারনা করছি, এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে রামপালে আজ শুক্রবার নতুন করে কিছু ঘের ভেসে গেছে। সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির হিসেবও করা হচ্ছে।
পটুয়াখালীতে ৭ হাজার পুকুর ও ১৬০০ চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে:
উপকূল সংলগ্ন পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ৭ হাজার মাছের পুকুর ও ১ হাজার ৬০০টি চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৫৫ কোটি ২৩ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন জেলা মৎস কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ। ক্ষয়ক্ষতির ৮০ ভাগ চিংচির ঘের আর ২০ ভাগ সাদা প্রজাতির মাছ।
এছাড়া ইয়াসের তাণ্ডবে জেলায় ৪৮৪টি কাঁচা ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ৪২০৯টি কাঁচা ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ইয়াস মোকাবেলায় জেলায় এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, শিশু ও গো-খাদ্যের জন্য ২ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা প্রথমিকভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া চাল, ডাল, আলু, লবণ, তেল সম্বলিত ৩ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার প্যাকেট বরাদ্দের কথা জানিয়েছেন জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার সরকার।
ঝালকাঠিতে ভেসে গেছে ৩ কোটি টাকার মাছ:
ঝালকাঠিতে ইয়াসের তাণ্ডবে জেলায় ৩.৭৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে ২ হাজার ১৩৯টি পুকুর, দিঘী ও খামারের মাছ।
জেলা মৎস বিভিাগ জানিয়েছে, ১৩৫ মেট্রিকটন মাছ এবং ৩১ লাখ ৫৩ হাজার মাছের পোনা ভেসে গেছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, জেলার মৎস্য চাষিদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করে বিভাগীয় অফিসে প্রেরণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উপকরণ পেলে তা মৎস্য চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।