ঢাকা ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবেশ দূষণরোধে ভূমিকা রাখবে ঢাকার খাল

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট : ০১:২১:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ জুন ২০২১
  • / 290

মো. কামাল হোসেন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঢাকা ছিল এক সময় মোগলদের কাছে আকর্ষণীয় শহর। প্রাকৃতিক সুবিধাই মোগলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে আকর্ষণ করে। এখনকার ঢাকা শহর দেখে বোঝার উপায় নেই যে, মাত্র একশ বছর আগেই ঢাকার ভৌগোলিক পরিবেশ কতটা মনোরম আর স্বাস্থ্যকর ছিল। দুনিয়ায় এমন রাজধানী খুব কমই আছে যার চারপাশে বৃত্তাকারে বেষ্টিত করে রেখেছে অনেক বড় নদী। ইতালির ভেনিস নগরীর সঙ্গে একে অনেকেই তুলনা করতো। চারপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, টঙ্গী ও তুরাগের মতো পাঁচটি নদী, ভেতর দিয়ে শতাধিক খালের প্রবাহ আর উপকণ্ঠজুড়ে বিস্তীর্ণ বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল নিয়ে একসময় ঢাকা প্রাকৃতিকভাবেই ছিল জলাবদ্ধতাবিহীন পরিবেশবান্ধব নগরী।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপই ঢাকা শহরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই শহরের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে সেটি বজায় থাকলে শহরের পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণের হার আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকবে। আর বর্তমানের মতো পরিবেশ দূষণ চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকা শহর হতে পারে বসবাস অনুপযোগী শহর। বলা হয়ে থাকে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যে বিষয়গুলো প্রভাব ফেলে তার মধ্যে পুষ্টির পরেই পরিবেশের অবস্থান। ঢাকার পরিবেশ দূষণ কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি তুলে ধরেছে বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে বেশির ভাগ সময় ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।

দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ মোকাবেলার প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। এই দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তবে সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

শুধু বায়ু নয় ঢাকা শহরের পরিবেশ নিয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশুদ্ধ এবং সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। এ সংকটের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলাশয় কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া।

গাছপালা কমে যাওয়া বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাবও ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। গাছপালা মানুষের নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয় পরিবেশে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জলাশয়ের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। এটা পরিবেশ ঠান্ডা রাখে।

ভূখণ্ডের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে। ভূখন্ডের উপরের জলাশয় কমে যাওয়ায় দিন দিন মাটির গভীরের পানির স্তরও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে আরো নিচে। নগরবিদরা বরাবরই বলে আসছেন ঢাকার ভারসাম্যহীন পরিবেশের জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এমনকি আবাসিক এলাকা, কোনোটাতেই নেই সঠিক ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার ছাপ।

পরিবেশ দূষণের কারণে সকলের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত, বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়।

বিশেষজ্ঞগণের মতে, দূষণের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত বাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুন্দর, টেকসই ও পরিবেশসম্মত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের জন্য সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কার্যকরভাবে মোকাবেলায় বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের রয়েছে অনেক আইন ও বিধি ।

এর মধ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও কর্মকৌশল-২০০৯, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১২ এবং জাতীয় পরিবেশ পদক নীতিমালা-২০১০ অন্যতম।

বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অভিঘাতের সাথে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন এবং প্রশমন বা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস- এ দুই খাতেই বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সম্প্রতি সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭ জারি করেছে। প্রকৃতির ক্ষতি করে, পরিবেশ বিনষ্ট করে ভালো থাকা যায় না, সুন্দরভাবে জীবনযাপন করাও সম্ভব নয়।

মানুষের যেমন মূল্য আছে, পরিবেশেরও তেমনি মূল্য আছে। ঢাকা শহরের পরিবেশ উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে পরিবেশ উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। ঢাকার পরিবেশ উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে খাল পুনরুদ্ধার, অবৈধ দখলমুক্ত, সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

এ উদ্যোগকে নাগরিক সমাজ সাধুবাদ জানিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঢাকার খালগুলো দিয়ে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেত। স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তী সময়ে এই এলাকায় নৌপথের মাধ্যমেই মালামাল পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটতে থাকে। সেই সময়ের যোগাযোগ প্রধানত নৌ পরিবহন ব্যবস্থার ওপরই নির্ভরশীল ছিল।

নদী নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় ৭৩টি খাল রয়েছে। তবে ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৫৮টি। তখন জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব খালের মধ্যে ৩৭টি খালেই দখলদার রয়েছে। ফলে এসব খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। আর বাকি সব কটি খালের জায়গায় রাস্তা হয়েছে।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উন্নয়নের নামে অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। আজ অবশিষ্টগুলোও সংকটাপন্ন। যেসব খাল দিয়ে এক সময় স্টিমার চলতো এখন সেখান দিয়ে নৌকাও চলে না। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিল, তা আজ বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, পানি সংকট এবং হ্রাস পাচ্ছে মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য। আমাদের নানা অদূরদর্শী কর্মকাণ্ড এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। খালগুলো ভরাট করে ভবন, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও ড্রেন বানানো হয়েছে।

ঢাকার কোনো কোনো খাল সকলের চোখের সামনেই সরাসরি, আবার কোনোটি আবর্জনা ফেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মূলত স্বাধীনতার পর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঢাকা শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট হতে থাকে। যার ফলাফল হিসেবে নব্বই সালের পর থেকে ঢাকায় জলাবদ্ধতা সংকট প্রকটতর হচ্ছে। নগরীতে অবস্থিত খাল ও জলাশয় ভরাট হওয়াই এই জলাবদ্ধতার মূল কারণ। ঢাকা শহরে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে জনজীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়।

দখল-দূষণের সঙ্গে নানা ধরনের আবর্জনা জমে ঢাকার খালগুলোর প্রস্থ কমে তা সরু নালায় রূপ নিয়েছে। কিছু এলাকায় আবর্জনা এমনভাবে জমে আছে সেখানে কোনো খাল আছে কি না, সেটিও বোঝার উপায় নেই। চারদিকে উৎকট গন্ধের কারণে খালপাড়ের বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ। পথচারীদেরও চলতে হয় নাক চেপে। অর্থাৎ নির্মল পরিবেশ সেখানে ছিল অনুপস্থিত।
ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। খালগুলোতে এখন পানির প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর ৩৯টি খাল চিহ্নিত করে অবৈধ দখলমুক্ত, সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সিএস নকশা অনুযায়ী খালের সীমানা চিহ্নিত করা হবে। সিএস পরবর্তী রেকর্ড পরিবর্তন করে যেসব খাল দখল হয়েছে, তাও সংশোধন করা হবে।

এছাড়া খালের পাড়ে থাকা নকশাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনাও একযোগে উচ্ছেদ করবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। পাশাপাশি বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ নদী বা খালে দেওয়া বন্ধ না করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। ইতোমধ্যে খালগুলো পুনরুদ্ধার, খনন ও সংস্কারের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। সিএস নকশা অনুযায়ী খালের পুরো চরিত্র ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের কার্যক্রম নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার পানি নিষ্কাশনের প্রধান চ্যানেল হিসেবে কালুনগর, জিরানী খাল, মাণ্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, পান্থকুঞ্জ বক্স কালভার্ট ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রথম খাল উদ্ধার ও খনন শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ৩০ মে ২০২০ হাজী ক্যাম্প সংলগ্ন ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দের্ঘ্যের এডি-৮ খাল খনন শুরু হয়। এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় নগরবাসী। এরপর যে খালগুলোর উদ্ধার ও খনন শুরু হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ইব্রাহিমপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, গোদাগাড়ী খাল, রূপনগর খাল, সাগুফতা খালসহ ১৪টি খাল, অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জিরানী খাল, মাণ্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, কদমতলা খাল, কমলাপুর খাল উদ্ধার করে খননের মাধ্যমে বর্জ অপসারণ করা হয়েছে।

ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করতো। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের খাল (প্রায় ৮০ কিলোমিটার) এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন এতদিন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে আসছিল। দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করে প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ লক্ষ্যে সেদিন ওয়াসার সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনের চুক্তি হয়।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ফলে এখন ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের পুরো দায়িত্ব পেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকার ২৬টি খাল ওয়াসার কাছ থেকে ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই সিটি করপোরেশনই খাল উদ্ধার ও খনন শুরু করেছে। পরিকল্পনা নিয়েছে আরো অগ্রবর্তী কাজের। বিশ্বের অনেক দেশেই খালগুলোকে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটাকে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ঢাকা সিটিতেও সে রকম ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করার পরিকল্পনা আছে। খালগুলো সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার ও পরিষ্কার করার পর এগুলোতে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করা হবে। খালগুলোতে যেসব ব্রিজ আছে, সেগুলো উন্নত বিশ্বের আদলে উঁচু করে তৈরি করলে নৌকা বা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। পুরো ঢাকা শহরে ইন্টারকানেকশন নৌরুট চালু করা হবে বলে জানা গেছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে সড়ক পথের ওপর চাপ কমবে, যানজট কমবে।

কিন্তু খালের পানিতে ময়লা থাকলে মানুষ পানিপথে ভ্রমণ করবে না। এজন্য যার যার বাসার পয়োবর্জ্য তার নিজস্ব সেপটিক ট্যাংকে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে এসব খালে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। এজন্য ঢাকার কোনো ভবন থেকে পয়োবর্জ্য আর খালে ফেলতে দেওয়া হবে না।

আর স্বচ্ছ পানিতে মাছ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দুই পাড়ে সারি সারি গাছ এবং হাঁটার চওড়া রাস্তা তৈরি করা হবে। খালের পানি যাতে সারা বছর পরিষ্কার রাখা যায় তার জন্য খাল দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এ সকল পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ঢাকার বাসিন্দাদের নির্মল পরিবেশে কিছুটা বিনোদনেরও সুযোগ তৈরি করে দিবে।

নগরের বাসিন্দারাই খাল দখল করে, ভরাট করে, ময়লা ফেলে ভাগাড় বানায়। এ বিষয়ে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। ময়লা আবর্জনার জন্য নির্ধারিত স্থানে ময়লা ফেলতে অভ্যস্ত করতে হবে । খালের স্বাভাবিক গতি সচল রাখতে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। সেটা করা না গেলে ঢাকার খাল পুনরুদ্ধার করেও ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা কিংবা খালের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে ভাবতে হবে কীভাবে ঢাকার পুনরুদ্ধার করা খালগুলোকে চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। এটা করা সম্ভব হলে আগামীর ঢাকাবাসী নদী-খাল-জলাশয় আর সবুজের ভেতর বসবাসের সুযোগ পাবে।

পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে কোনো বৈরিতা না করে আমাদেরকে সেতুবন্ধ রচনা করতে হবে। পরিবেশ বিনষ্ট না করে প্রকৃত বন্ধু হয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা ভাবতে হবে। প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব জীবনকে সমৃদ্ধ করে, জীবনধারণকে আরও সুন্দর ও উপযোগী করে তোলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকারার্থে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নগর উপহার দিতে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। সরকার সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা আর সমন্বিত উদ্যোগ।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পরিবেশ দূষণরোধে ভূমিকা রাখবে ঢাকার খাল

আপডেট : ০১:২১:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ জুন ২০২১

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঢাকা ছিল এক সময় মোগলদের কাছে আকর্ষণীয় শহর। প্রাকৃতিক সুবিধাই মোগলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে আকর্ষণ করে। এখনকার ঢাকা শহর দেখে বোঝার উপায় নেই যে, মাত্র একশ বছর আগেই ঢাকার ভৌগোলিক পরিবেশ কতটা মনোরম আর স্বাস্থ্যকর ছিল। দুনিয়ায় এমন রাজধানী খুব কমই আছে যার চারপাশে বৃত্তাকারে বেষ্টিত করে রেখেছে অনেক বড় নদী। ইতালির ভেনিস নগরীর সঙ্গে একে অনেকেই তুলনা করতো। চারপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, টঙ্গী ও তুরাগের মতো পাঁচটি নদী, ভেতর দিয়ে শতাধিক খালের প্রবাহ আর উপকণ্ঠজুড়ে বিস্তীর্ণ বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল নিয়ে একসময় ঢাকা প্রাকৃতিকভাবেই ছিল জলাবদ্ধতাবিহীন পরিবেশবান্ধব নগরী।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপই ঢাকা শহরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই শহরের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে সেটি বজায় থাকলে শহরের পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণের হার আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকবে। আর বর্তমানের মতো পরিবেশ দূষণ চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকা শহর হতে পারে বসবাস অনুপযোগী শহর। বলা হয়ে থাকে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যে বিষয়গুলো প্রভাব ফেলে তার মধ্যে পুষ্টির পরেই পরিবেশের অবস্থান। ঢাকার পরিবেশ দূষণ কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি তুলে ধরেছে বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে বেশির ভাগ সময় ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।

দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ মোকাবেলার প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। এই দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তবে সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

শুধু বায়ু নয় ঢাকা শহরের পরিবেশ নিয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশুদ্ধ এবং সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। এ সংকটের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলাশয় কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া।

গাছপালা কমে যাওয়া বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাবও ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। গাছপালা মানুষের নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয় পরিবেশে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জলাশয়ের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। এটা পরিবেশ ঠান্ডা রাখে।

ভূখণ্ডের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে। ভূখন্ডের উপরের জলাশয় কমে যাওয়ায় দিন দিন মাটির গভীরের পানির স্তরও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে আরো নিচে। নগরবিদরা বরাবরই বলে আসছেন ঢাকার ভারসাম্যহীন পরিবেশের জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এমনকি আবাসিক এলাকা, কোনোটাতেই নেই সঠিক ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার ছাপ।

পরিবেশ দূষণের কারণে সকলের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত, বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়।

বিশেষজ্ঞগণের মতে, দূষণের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত বাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুন্দর, টেকসই ও পরিবেশসম্মত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের জন্য সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কার্যকরভাবে মোকাবেলায় বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের রয়েছে অনেক আইন ও বিধি ।

এর মধ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও কর্মকৌশল-২০০৯, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১২ এবং জাতীয় পরিবেশ পদক নীতিমালা-২০১০ অন্যতম।

বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অভিঘাতের সাথে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন এবং প্রশমন বা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস- এ দুই খাতেই বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সম্প্রতি সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭ জারি করেছে। প্রকৃতির ক্ষতি করে, পরিবেশ বিনষ্ট করে ভালো থাকা যায় না, সুন্দরভাবে জীবনযাপন করাও সম্ভব নয়।

মানুষের যেমন মূল্য আছে, পরিবেশেরও তেমনি মূল্য আছে। ঢাকা শহরের পরিবেশ উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে পরিবেশ উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। ঢাকার পরিবেশ উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে খাল পুনরুদ্ধার, অবৈধ দখলমুক্ত, সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

এ উদ্যোগকে নাগরিক সমাজ সাধুবাদ জানিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঢাকার খালগুলো দিয়ে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেত। স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তী সময়ে এই এলাকায় নৌপথের মাধ্যমেই মালামাল পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটতে থাকে। সেই সময়ের যোগাযোগ প্রধানত নৌ পরিবহন ব্যবস্থার ওপরই নির্ভরশীল ছিল।

নদী নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় ৭৩টি খাল রয়েছে। তবে ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৫৮টি। তখন জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব খালের মধ্যে ৩৭টি খালেই দখলদার রয়েছে। ফলে এসব খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। আর বাকি সব কটি খালের জায়গায় রাস্তা হয়েছে।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উন্নয়নের নামে অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। আজ অবশিষ্টগুলোও সংকটাপন্ন। যেসব খাল দিয়ে এক সময় স্টিমার চলতো এখন সেখান দিয়ে নৌকাও চলে না। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিল, তা আজ বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, পানি সংকট এবং হ্রাস পাচ্ছে মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য। আমাদের নানা অদূরদর্শী কর্মকাণ্ড এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। খালগুলো ভরাট করে ভবন, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও ড্রেন বানানো হয়েছে।

ঢাকার কোনো কোনো খাল সকলের চোখের সামনেই সরাসরি, আবার কোনোটি আবর্জনা ফেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মূলত স্বাধীনতার পর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঢাকা শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট হতে থাকে। যার ফলাফল হিসেবে নব্বই সালের পর থেকে ঢাকায় জলাবদ্ধতা সংকট প্রকটতর হচ্ছে। নগরীতে অবস্থিত খাল ও জলাশয় ভরাট হওয়াই এই জলাবদ্ধতার মূল কারণ। ঢাকা শহরে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে জনজীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়।

দখল-দূষণের সঙ্গে নানা ধরনের আবর্জনা জমে ঢাকার খালগুলোর প্রস্থ কমে তা সরু নালায় রূপ নিয়েছে। কিছু এলাকায় আবর্জনা এমনভাবে জমে আছে সেখানে কোনো খাল আছে কি না, সেটিও বোঝার উপায় নেই। চারদিকে উৎকট গন্ধের কারণে খালপাড়ের বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ। পথচারীদেরও চলতে হয় নাক চেপে। অর্থাৎ নির্মল পরিবেশ সেখানে ছিল অনুপস্থিত।
ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। খালগুলোতে এখন পানির প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর ৩৯টি খাল চিহ্নিত করে অবৈধ দখলমুক্ত, সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সিএস নকশা অনুযায়ী খালের সীমানা চিহ্নিত করা হবে। সিএস পরবর্তী রেকর্ড পরিবর্তন করে যেসব খাল দখল হয়েছে, তাও সংশোধন করা হবে।

এছাড়া খালের পাড়ে থাকা নকশাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনাও একযোগে উচ্ছেদ করবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। পাশাপাশি বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ নদী বা খালে দেওয়া বন্ধ না করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। ইতোমধ্যে খালগুলো পুনরুদ্ধার, খনন ও সংস্কারের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। সিএস নকশা অনুযায়ী খালের পুরো চরিত্র ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের কার্যক্রম নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার পানি নিষ্কাশনের প্রধান চ্যানেল হিসেবে কালুনগর, জিরানী খাল, মাণ্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, পান্থকুঞ্জ বক্স কালভার্ট ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রথম খাল উদ্ধার ও খনন শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ৩০ মে ২০২০ হাজী ক্যাম্প সংলগ্ন ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দের্ঘ্যের এডি-৮ খাল খনন শুরু হয়। এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় নগরবাসী। এরপর যে খালগুলোর উদ্ধার ও খনন শুরু হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ইব্রাহিমপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, গোদাগাড়ী খাল, রূপনগর খাল, সাগুফতা খালসহ ১৪টি খাল, অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জিরানী খাল, মাণ্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, কদমতলা খাল, কমলাপুর খাল উদ্ধার করে খননের মাধ্যমে বর্জ অপসারণ করা হয়েছে।

ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করতো। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের খাল (প্রায় ৮০ কিলোমিটার) এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন এতদিন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে আসছিল। দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করে প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ লক্ষ্যে সেদিন ওয়াসার সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনের চুক্তি হয়।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ফলে এখন ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের পুরো দায়িত্ব পেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকার ২৬টি খাল ওয়াসার কাছ থেকে ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই সিটি করপোরেশনই খাল উদ্ধার ও খনন শুরু করেছে। পরিকল্পনা নিয়েছে আরো অগ্রবর্তী কাজের। বিশ্বের অনেক দেশেই খালগুলোকে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটাকে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ঢাকা সিটিতেও সে রকম ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করার পরিকল্পনা আছে। খালগুলো সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার ও পরিষ্কার করার পর এগুলোতে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু করা হবে। খালগুলোতে যেসব ব্রিজ আছে, সেগুলো উন্নত বিশ্বের আদলে উঁচু করে তৈরি করলে নৌকা বা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। পুরো ঢাকা শহরে ইন্টারকানেকশন নৌরুট চালু করা হবে বলে জানা গেছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে সড়ক পথের ওপর চাপ কমবে, যানজট কমবে।

কিন্তু খালের পানিতে ময়লা থাকলে মানুষ পানিপথে ভ্রমণ করবে না। এজন্য যার যার বাসার পয়োবর্জ্য তার নিজস্ব সেপটিক ট্যাংকে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে এসব খালে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। এজন্য ঢাকার কোনো ভবন থেকে পয়োবর্জ্য আর খালে ফেলতে দেওয়া হবে না।

আর স্বচ্ছ পানিতে মাছ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দুই পাড়ে সারি সারি গাছ এবং হাঁটার চওড়া রাস্তা তৈরি করা হবে। খালের পানি যাতে সারা বছর পরিষ্কার রাখা যায় তার জন্য খাল দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এ সকল পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ঢাকার বাসিন্দাদের নির্মল পরিবেশে কিছুটা বিনোদনেরও সুযোগ তৈরি করে দিবে।

নগরের বাসিন্দারাই খাল দখল করে, ভরাট করে, ময়লা ফেলে ভাগাড় বানায়। এ বিষয়ে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। ময়লা আবর্জনার জন্য নির্ধারিত স্থানে ময়লা ফেলতে অভ্যস্ত করতে হবে । খালের স্বাভাবিক গতি সচল রাখতে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। সেটা করা না গেলে ঢাকার খাল পুনরুদ্ধার করেও ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা কিংবা খালের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে ভাবতে হবে কীভাবে ঢাকার পুনরুদ্ধার করা খালগুলোকে চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। এটা করা সম্ভব হলে আগামীর ঢাকাবাসী নদী-খাল-জলাশয় আর সবুজের ভেতর বসবাসের সুযোগ পাবে।

পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে কোনো বৈরিতা না করে আমাদেরকে সেতুবন্ধ রচনা করতে হবে। পরিবেশ বিনষ্ট না করে প্রকৃত বন্ধু হয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা ভাবতে হবে। প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব জীবনকে সমৃদ্ধ করে, জীবনধারণকে আরও সুন্দর ও উপযোগী করে তোলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকারার্থে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নগর উপহার দিতে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। সরকার সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা আর সমন্বিত উদ্যোগ।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়