বিএনপির মিছিলে থাকা তরুণ ভোটার কতটুকু জানে তারেকনামা

মুহাম্মদ মামুন শেখ
  • আপডেট : ০২:০২:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অগাস্ট ২০২৩
  • / 240

 

শুরুটা একটা প্রশ্ন দিয়ে করতে চাই। ঢাকার রাস্তায় চলতে চলতে প্রশ্নটা জন্মেছে, বিএনপির সমাবেশ হলে তার আগে যখন শহরজুড়ে মাইকিং করা হয় ‘উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকরুল ইসলাম আলমগীর’, কিন্তু সেই একই সভার ব্যানারে কোথাও কেনো ফখরুল ভাইয়ের নামের আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখা হয়না? বিএনপির মিছিলে দেখা সব তরুণ যারা আমার সন্তানতুল্য, এ প্রশ্ন যদি তাঁদের মধ্যে নতুন কোনো প্রশ্ন জন্ম দেয়, তবেই আমি সার্থক। তরুণদের রাজনীতিতে দেখতে পাওয়া আমাদের জন্য সুখকর। অবশ্যই আমি রাজনৈতিক বোধে সচেতন এক আগামী প্রজন্ম দেখতে চাই, সেই সামান্য বাসনা থেকে এ প্রশ্ন।

তবে এ প্রশ্ন শুধু তরুণদের জন্য নয়, জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে যাদের লম্ফজম্ফ দেখি, তাদের জন্যও। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এর মত অসাম্প্রদায়িক দেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তার দায় কাকে দিবে প্রজন্ম। কিভাবে ৬৪ জেলায় বোমা হামলা হয়। আদালতে কি ভাবে মেরে ফেলা হয় বিচারককে। সে ইতিহাস নিশ্চয়ই এ প্রজন্মরে তরুণ তারেক রহমানের ফলোয়াররা খুঁজে নিবে।

যাই হোক, তারেকনামা লিখতে গিয়ে ফকরুলনামা দিয়ে শুরু করতে হল। কারণ তরুণ ভোটারদের জন্য দুঃসময়ের ২০০১ – ২০০৫ বেশ খানিকটা পেছনে।

২০ বছর আগে হুইল চেয়ারে বসা ক্লান্ত তারেকের ভিডিও যতটা দেখা যায় বিএনপির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ততটা দেখা যায়না টানা ৫ বার দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ান করা সো কলড রাজপুত্রের বাকী ইতিহাস। শুরু করি প্রায়ত নির্মাতা তারেক মাসুদের সিনেমার গল্প দিয়ে।

তার সিনেমা রানওয়ের একটা দৃশ্যে একজন শীর্ষ জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে একজন অদৃশ্য শীর্ষনেতার বক্তব্য দেখতে পাওয়া যায়। বিচিত্র হলেও সত্যি, উইকিলিকসের নথিতে এমন তথ্যই দেওয়া, তখনকার অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের চিফ কমান্ডিং অফিসার কামারুলকে (মাহতাব খামারু) একজন শীর্ষনেতার টেলিফোনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় র‌্যাব। সেই শীর্ষনেতাটির নাম তারেক রহমান।

এখন বিচক্ষণ তরুণ বিএনপি ভোটারগণ কি এমন দাবি করবেন যে, উইকিলিকস আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা মেশিন!
উইকিলিকসের দেওয়া তথ্য বলে, ২০০৮ সালের নভেম্বরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো একটি গোপন তারবার্তায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘তারেকের আর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের ইতিহাস আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করে এবং একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মার্কিন লক্ষ্যকে ক্ষুন্ন করার হুমকি দেয়’।

এখন ওনারা যখন আমেরিকার নয়া ভিসানীতি নিয়া বয়ান দেন, তখন একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে ৯ /১১ প্রেক্ষাপটে দেলোয়ার হোসেন সাইদীয়র পর তারেক রহমানকে সব চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল আমেরিকা। তখনকার দূতাবাস যেভাবে তারেক রহমানকে চিত্রাঙ্কন করেছিল ‘তারেক রহমান- এ সিম্বল অব ভায়োলেন্ট পলিটিক্স’।

এখন সিম্বল অব ভায়োলেন্ট পলিটিক্সের উদাহরণ ও ইতিহাস আপনারাও খুঁজে নিতে পারেন। তবে কিছুটা দায় আছে আমার, আপনাদের জানানোর; ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত থাকার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ঢাকার একটি আদালত।

সেদিন আইভি আপার রক্তাক্ত দেহ, বিচ্ছিন নেতাকর্মীর হাত পা, অথবা উড়ে যাওয়া মগজ যারা দেখেছে। তাঁরা জানেন- ‘আর সিম্বল অব ভায়োলেন্ট পলিটিক্স’ কেন বলেছিল তারেককে, সেদিন ২৪ জন মানুষ নিহত হয়। আর হুমুকদাতা তারেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে অবশ্য এ মামলায়। খালেদা জিয়া চুপচাপ রইলেন। আর তারেকের আঙ্গুল নির্ধারণ করতে রইল মানুষের বাঁচা মরা।
আসুন এবার জানি ব্যবসায়ী তারেক কে নিয়ে। ১৯৯১ সালে শুর হয় রহমান শিপার্স, তারপর দশ বছর মোটামুটি চুপচাপ কিন্তু ২০০১ সালের পর প্রতিষ্ঠা হতে থাকে রহমান গ্রুপ, ওয়ান গ্রুপ, রহমান নেভিগেশন, চ্যানেল ওয়ান, ডান্ডি ডায়িং, খাম্বা লিমিটেড, এডভান্স এড, আর কে গ্রুপ, টিএম এন্টারপ্রাইজ, ইউনিটেক্স এ্যাপারেলস, ক্রিমেন্টাইন লিমিটেড, ক্রোনোটেক্স লিমিটেড, তুরাগ ফিশারিজ, তাজ ডিস্টিলারিজ। গোয়েন্দা সূত্র মতে, তারেক ও মামুন প্রভাব বিস্তার করে ছোট-বড় মিলে ৫০টির মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং নামসর্বস্ব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৫ বছরে সব ধরনের ব্যবসা ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

এবার একটা যোগফল দেখা যাক জিয়া পরিবারের চুরির ইতিহাসের। বেলজিয়ামে তারেকের সম্পত্তির পরিমাণ ৭৫০ মিলিয়ন ডলার, মালয়েশিয়ায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার এবং দুবাইতে রয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাড়ি (বাড়ির ঠিকানা: স্প্রিং ১৪, ভিলা: ১২, এমিরেটস হিলস, দুবাই)। সৌদি আরবে মার্কেটসহ অন্যান্য সম্পত্তির কিছু বিবরণ পাওয়া যায় প্যারাডাইস পেপারসে। প্যারাডাইস পেপারের সূত্রে জানা যায়, তারেক জিয়া ২০০৪ এবং ২০০৫ সালে কেইম্যান আইসল্যান্ড এবং বারমুডায় ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন।

এখানেও একটা প্রশ্ন আছে। দেশ, জাতি ও জনতা নিয়ে ভাবা মানুষটা কি একটু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসায়ী মানুষিকতার? যদি তাই হবে তবে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?
তারেকের মাত্রাতিরিক্ততার তথ্য অবশ্য তৎকালীন প্রধানন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর কাছে পাওয়া যাবে। যদিও তারেক আতঙ্কেই তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী তাঁদের মা ছেলের মিলে মিশে ভাগবাটোয়ারা সাক্ষী হয়ে আছেন।

সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আসামি। তিনি বিদেশ থেকে আসামি হয়ে দুদকের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক মো. হারুন-উর-রশীদের কাছে একটা চিঠি পাঠান, আর সেই চিঠি প্রমাণ করে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা স্থানান্তর করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

অল্প একটু খালেদানামা যোগ করে দিলাম। আসুন একজন আন্তর্জাতিক মানের অর্থ পাচারকারির কথা জানি, অনেকে ভুলে গেছেন আর তরুণরা জানেন না। তারেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার অভিযোগের সাক্ষী দিতে আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এজেন্ট ডেব্রা ল্যাপ্রেভোট। এসব তথ্য এখনো নিশ্চয় আর্কাইভ হয়ে আছে। খুঁজলে পাবেন।

এবার তবে সেই অসাংবিধানিক ‘ছায়া সরকার’ ইতিহাস জানুন। হাওয়া ভবনে বসে সরকার চালাতেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। আমরা যারা হাওয়া ভবন দেখেছি, আমরা জানি, কি ভাবে রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে একটা প্যারালাল সরকার চালানোর মত অসাংবিধানিক পক্রিয়াকে মৌনতার বৈধতা দিয়েছিল খালেদা জিয়া।

এবার উইকিলিস বাদ দিয়ে প্যারাডাইস পেপারস এর পালা। তারেক রহমানের নাম মিলছেল প্যারাডাইস পেপারসের প্রকাশিত তালিকায় তা সবাই জানেন কি? গ্রাহকদের কর ফাঁকির পথ বাতলে দেয় অফশোর ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ পর্যায়ের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপলবি’। আর এই অ্যাপলবির ক্লায়েন্ট হলেন তারেক রহমান। লন্ডনের ঠিকানা দিয়ে অ্যাপলবির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন তারেক রহমান এবং ১৯৯৩-২০০৬ এই সময়ে মধ্যে ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি বিনিয়োগ করেছিলেন বেশ কিছু ট্যাক্স হেভেনে।

নাম ছিলো প্রায়ত আরাফাত রহমান কোকোর। তার বিষয়ে পাওয়া যায়, প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে মালেশিয়ায় ট্রান্সফার করেছিলেন। ওই অর্থগুলো বিনিয়োগ করা হয়েছিল এপ্লাইবাই এবং অন্যান্য বৈধ প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও ‘ওয়াকারস’নামের একটি আইন ফার্মের সহযোগিতায় ২০০২ সালের মার্চে তিনি বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়েছিলেন এবং ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করেছিলেন।এবারও কি কোনো বিচক্ষনতায় কেউ দাবি করবে, প্যারাডাইস পেপারসও বর্তমান সরকারের প্রপাগান্ডা মেশিন!
উইকিলিকস গেল, প্যারাডাইস পেপারস গেল আসুন এবার পানাম পেপারস নিয়ে কথা বলি, সেখানেও জিয়া পরিবারের বন্ধু একটি পরিবারের নাম এসেছে। ধারণা করা হয় তারেকের ইমেজ রক্ষার্থে সেই পরিবারটি মাধ্যমেই নতুন করে বিনিয়োগ করেছে তারেক রহমান। পানাম পেপারস সে সাক্ষী দিবে।

যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, একটি দেশের, একটি জাতির সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ন অর্জন নিয়ে এমন লুকোচুরি কেন করবেন মির্জা ফকরুল। যদি তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিসের বাধা? লিখতে কিসের ভয়। ফকরুল ভাই মন্ত্রী থাকতে মুক্তিযুদ্ধ করছেন মনে হয়, সার্টিফিকেট পাইছেন কি না জানিনা। তবে এমন অনৈতিক মানসিক অবস্থানে থাকা একজন মানুষ যখন আমার সন্তানের নেতা, তা বড়ই পরিতাপের, ঘৃণার এবং একই সাথে লজ্জার। আর বড় মিয়া। অপরাধের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তার নাম নেই ! তবুও এ প্রজন্মকে ভ্রান্তির ইতিহাস হাতে দিয়ে মিছিল দেওয়ানো হচ্ছে ‘নেতা মোদের তারেক জিয়া’। উপরের যা যা ইতিহাস আপনাদের জানাতে পেরেছি তা আমার জন্য ইতিহাসের দায় মুক্তির পথ। কিন্তু একটা দেশের জন্য, একটা জাতির জন্য, এমন একটা পরিবারকে যারা আদর্শিক নেতা মানেন, তাঁরা আসলে দেশটা ও মানুষের কাছ থেকে সত্যি দায় মুক্তি পাবে কি?

লেখক: সাংবাদিক

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বিএনপির মিছিলে থাকা তরুণ ভোটার কতটুকু জানে তারেকনামা

আপডেট : ০২:০২:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অগাস্ট ২০২৩

 

শুরুটা একটা প্রশ্ন দিয়ে করতে চাই। ঢাকার রাস্তায় চলতে চলতে প্রশ্নটা জন্মেছে, বিএনপির সমাবেশ হলে তার আগে যখন শহরজুড়ে মাইকিং করা হয় ‘উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকরুল ইসলাম আলমগীর’, কিন্তু সেই একই সভার ব্যানারে কোথাও কেনো ফখরুল ভাইয়ের নামের আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখা হয়না? বিএনপির মিছিলে দেখা সব তরুণ যারা আমার সন্তানতুল্য, এ প্রশ্ন যদি তাঁদের মধ্যে নতুন কোনো প্রশ্ন জন্ম দেয়, তবেই আমি সার্থক। তরুণদের রাজনীতিতে দেখতে পাওয়া আমাদের জন্য সুখকর। অবশ্যই আমি রাজনৈতিক বোধে সচেতন এক আগামী প্রজন্ম দেখতে চাই, সেই সামান্য বাসনা থেকে এ প্রশ্ন।

তবে এ প্রশ্ন শুধু তরুণদের জন্য নয়, জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে যাদের লম্ফজম্ফ দেখি, তাদের জন্যও। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এর মত অসাম্প্রদায়িক দেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তার দায় কাকে দিবে প্রজন্ম। কিভাবে ৬৪ জেলায় বোমা হামলা হয়। আদালতে কি ভাবে মেরে ফেলা হয় বিচারককে। সে ইতিহাস নিশ্চয়ই এ প্রজন্মরে তরুণ তারেক রহমানের ফলোয়াররা খুঁজে নিবে।

যাই হোক, তারেকনামা লিখতে গিয়ে ফকরুলনামা দিয়ে শুরু করতে হল। কারণ তরুণ ভোটারদের জন্য দুঃসময়ের ২০০১ – ২০০৫ বেশ খানিকটা পেছনে।

২০ বছর আগে হুইল চেয়ারে বসা ক্লান্ত তারেকের ভিডিও যতটা দেখা যায় বিএনপির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ততটা দেখা যায়না টানা ৫ বার দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ান করা সো কলড রাজপুত্রের বাকী ইতিহাস। শুরু করি প্রায়ত নির্মাতা তারেক মাসুদের সিনেমার গল্প দিয়ে।

তার সিনেমা রানওয়ের একটা দৃশ্যে একজন শীর্ষ জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে একজন অদৃশ্য শীর্ষনেতার বক্তব্য দেখতে পাওয়া যায়। বিচিত্র হলেও সত্যি, উইকিলিকসের নথিতে এমন তথ্যই দেওয়া, তখনকার অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের চিফ কমান্ডিং অফিসার কামারুলকে (মাহতাব খামারু) একজন শীর্ষনেতার টেলিফোনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় র‌্যাব। সেই শীর্ষনেতাটির নাম তারেক রহমান।

এখন বিচক্ষণ তরুণ বিএনপি ভোটারগণ কি এমন দাবি করবেন যে, উইকিলিকস আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা মেশিন!
উইকিলিকসের দেওয়া তথ্য বলে, ২০০৮ সালের নভেম্বরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো একটি গোপন তারবার্তায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘তারেকের আর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের ইতিহাস আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করে এবং একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মার্কিন লক্ষ্যকে ক্ষুন্ন করার হুমকি দেয়’।

এখন ওনারা যখন আমেরিকার নয়া ভিসানীতি নিয়া বয়ান দেন, তখন একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে ৯ /১১ প্রেক্ষাপটে দেলোয়ার হোসেন সাইদীয়র পর তারেক রহমানকে সব চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল আমেরিকা। তখনকার দূতাবাস যেভাবে তারেক রহমানকে চিত্রাঙ্কন করেছিল ‘তারেক রহমান- এ সিম্বল অব ভায়োলেন্ট পলিটিক্স’।

এখন সিম্বল অব ভায়োলেন্ট পলিটিক্সের উদাহরণ ও ইতিহাস আপনারাও খুঁজে নিতে পারেন। তবে কিছুটা দায় আছে আমার, আপনাদের জানানোর; ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত থাকার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ঢাকার একটি আদালত।

সেদিন আইভি আপার রক্তাক্ত দেহ, বিচ্ছিন নেতাকর্মীর হাত পা, অথবা উড়ে যাওয়া মগজ যারা দেখেছে। তাঁরা জানেন- ‘আর সিম্বল অব ভায়োলেন্ট পলিটিক্স’ কেন বলেছিল তারেককে, সেদিন ২৪ জন মানুষ নিহত হয়। আর হুমুকদাতা তারেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে অবশ্য এ মামলায়। খালেদা জিয়া চুপচাপ রইলেন। আর তারেকের আঙ্গুল নির্ধারণ করতে রইল মানুষের বাঁচা মরা।
আসুন এবার জানি ব্যবসায়ী তারেক কে নিয়ে। ১৯৯১ সালে শুর হয় রহমান শিপার্স, তারপর দশ বছর মোটামুটি চুপচাপ কিন্তু ২০০১ সালের পর প্রতিষ্ঠা হতে থাকে রহমান গ্রুপ, ওয়ান গ্রুপ, রহমান নেভিগেশন, চ্যানেল ওয়ান, ডান্ডি ডায়িং, খাম্বা লিমিটেড, এডভান্স এড, আর কে গ্রুপ, টিএম এন্টারপ্রাইজ, ইউনিটেক্স এ্যাপারেলস, ক্রিমেন্টাইন লিমিটেড, ক্রোনোটেক্স লিমিটেড, তুরাগ ফিশারিজ, তাজ ডিস্টিলারিজ। গোয়েন্দা সূত্র মতে, তারেক ও মামুন প্রভাব বিস্তার করে ছোট-বড় মিলে ৫০টির মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং নামসর্বস্ব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৫ বছরে সব ধরনের ব্যবসা ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

এবার একটা যোগফল দেখা যাক জিয়া পরিবারের চুরির ইতিহাসের। বেলজিয়ামে তারেকের সম্পত্তির পরিমাণ ৭৫০ মিলিয়ন ডলার, মালয়েশিয়ায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার এবং দুবাইতে রয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাড়ি (বাড়ির ঠিকানা: স্প্রিং ১৪, ভিলা: ১২, এমিরেটস হিলস, দুবাই)। সৌদি আরবে মার্কেটসহ অন্যান্য সম্পত্তির কিছু বিবরণ পাওয়া যায় প্যারাডাইস পেপারসে। প্যারাডাইস পেপারের সূত্রে জানা যায়, তারেক জিয়া ২০০৪ এবং ২০০৫ সালে কেইম্যান আইসল্যান্ড এবং বারমুডায় ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন।

এখানেও একটা প্রশ্ন আছে। দেশ, জাতি ও জনতা নিয়ে ভাবা মানুষটা কি একটু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসায়ী মানুষিকতার? যদি তাই হবে তবে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?
তারেকের মাত্রাতিরিক্ততার তথ্য অবশ্য তৎকালীন প্রধানন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর কাছে পাওয়া যাবে। যদিও তারেক আতঙ্কেই তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী তাঁদের মা ছেলের মিলে মিশে ভাগবাটোয়ারা সাক্ষী হয়ে আছেন।

সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আসামি। তিনি বিদেশ থেকে আসামি হয়ে দুদকের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক মো. হারুন-উর-রশীদের কাছে একটা চিঠি পাঠান, আর সেই চিঠি প্রমাণ করে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা স্থানান্তর করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

অল্প একটু খালেদানামা যোগ করে দিলাম। আসুন একজন আন্তর্জাতিক মানের অর্থ পাচারকারির কথা জানি, অনেকে ভুলে গেছেন আর তরুণরা জানেন না। তারেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার অভিযোগের সাক্ষী দিতে আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এজেন্ট ডেব্রা ল্যাপ্রেভোট। এসব তথ্য এখনো নিশ্চয় আর্কাইভ হয়ে আছে। খুঁজলে পাবেন।

এবার তবে সেই অসাংবিধানিক ‘ছায়া সরকার’ ইতিহাস জানুন। হাওয়া ভবনে বসে সরকার চালাতেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। আমরা যারা হাওয়া ভবন দেখেছি, আমরা জানি, কি ভাবে রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে একটা প্যারালাল সরকার চালানোর মত অসাংবিধানিক পক্রিয়াকে মৌনতার বৈধতা দিয়েছিল খালেদা জিয়া।

এবার উইকিলিস বাদ দিয়ে প্যারাডাইস পেপারস এর পালা। তারেক রহমানের নাম মিলছেল প্যারাডাইস পেপারসের প্রকাশিত তালিকায় তা সবাই জানেন কি? গ্রাহকদের কর ফাঁকির পথ বাতলে দেয় অফশোর ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ পর্যায়ের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপলবি’। আর এই অ্যাপলবির ক্লায়েন্ট হলেন তারেক রহমান। লন্ডনের ঠিকানা দিয়ে অ্যাপলবির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন তারেক রহমান এবং ১৯৯৩-২০০৬ এই সময়ে মধ্যে ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি বিনিয়োগ করেছিলেন বেশ কিছু ট্যাক্স হেভেনে।

নাম ছিলো প্রায়ত আরাফাত রহমান কোকোর। তার বিষয়ে পাওয়া যায়, প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে মালেশিয়ায় ট্রান্সফার করেছিলেন। ওই অর্থগুলো বিনিয়োগ করা হয়েছিল এপ্লাইবাই এবং অন্যান্য বৈধ প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও ‘ওয়াকারস’নামের একটি আইন ফার্মের সহযোগিতায় ২০০২ সালের মার্চে তিনি বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়েছিলেন এবং ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করেছিলেন।এবারও কি কোনো বিচক্ষনতায় কেউ দাবি করবে, প্যারাডাইস পেপারসও বর্তমান সরকারের প্রপাগান্ডা মেশিন!
উইকিলিকস গেল, প্যারাডাইস পেপারস গেল আসুন এবার পানাম পেপারস নিয়ে কথা বলি, সেখানেও জিয়া পরিবারের বন্ধু একটি পরিবারের নাম এসেছে। ধারণা করা হয় তারেকের ইমেজ রক্ষার্থে সেই পরিবারটি মাধ্যমেই নতুন করে বিনিয়োগ করেছে তারেক রহমান। পানাম পেপারস সে সাক্ষী দিবে।

যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, একটি দেশের, একটি জাতির সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ন অর্জন নিয়ে এমন লুকোচুরি কেন করবেন মির্জা ফকরুল। যদি তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিসের বাধা? লিখতে কিসের ভয়। ফকরুল ভাই মন্ত্রী থাকতে মুক্তিযুদ্ধ করছেন মনে হয়, সার্টিফিকেট পাইছেন কি না জানিনা। তবে এমন অনৈতিক মানসিক অবস্থানে থাকা একজন মানুষ যখন আমার সন্তানের নেতা, তা বড়ই পরিতাপের, ঘৃণার এবং একই সাথে লজ্জার। আর বড় মিয়া। অপরাধের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তার নাম নেই ! তবুও এ প্রজন্মকে ভ্রান্তির ইতিহাস হাতে দিয়ে মিছিল দেওয়ানো হচ্ছে ‘নেতা মোদের তারেক জিয়া’। উপরের যা যা ইতিহাস আপনাদের জানাতে পেরেছি তা আমার জন্য ইতিহাসের দায় মুক্তির পথ। কিন্তু একটা দেশের জন্য, একটা জাতির জন্য, এমন একটা পরিবারকে যারা আদর্শিক নেতা মানেন, তাঁরা আসলে দেশটা ও মানুষের কাছ থেকে সত্যি দায় মুক্তি পাবে কি?

লেখক: সাংবাদিক