ঢাকা ০৫:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঘুষ না পেলে থমকে যায় গৃহায়নের প্রকল্প নেপথ্যে মোসলেউদ্দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : ০৭:৫৩:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪
  • / 263

সাধারণ মানুষের আবাসন নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকলেও নিজেদের উন্নয়নেই বেশি মনোযোগী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) কর্মকর্তারা। পদে পদে অনিয়ম, ফাইল নড়াতে ঘুষ, বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধারে ঢিলেমি—সবই চলে প্রতিষ্ঠানটিতে। বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক পন্থায় কোটি কোটি টাকা আয় করলেও সাধারণ মানুষ একেবারেই সেবাবঞ্চিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, বর্তমানে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাগৃকের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। সংস্থাটির চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান সব মহলে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে (জাগৃক) উচ্চমান সহকারী পদে চাকরি করেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদকও। নামে-বেনামে মালিক বনে গেছেন কয়েকশ কোটি টাকার। তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু দেলোয়ারই নন, নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট দখলের মাধ্যমে এমন অসংখ্য কোটিপতি তৈরি হয়েছে জাগৃকে। তারা নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট নেওয়ার পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামেও একাধিক বরাদ্দ নিয়েছেন।

সরকারি প্রতিষ্ঠানটির অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব প্লট-ফ্ল্যাট নেন। অথচ মন্ত্রণালয়ের বিধিতেই বলা হয়েছে, একটির বেশি কেউ বরাদ্দ নিতে পারবে না। আবার চাকরির মেয়াদ দুই বছর না হলে বরাদ্দ নেওয়া যাবে না। আবার অনেকে নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট না নিলেও নিয়েছেন স্বজনদের নামে। ঘুষ এবং তদবিরের বিনিময়ে আয় করেছেন বিপুল অর্থ। অনিয়মে গচ্চা ৮৬ কোটি টাকা: মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশনে ১১২ কাঠা জমি রয়েছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। বাজারদর অনুযায়ী ওই এলাকায় কাঠাপ্রতি জমির দাম প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু সেখানে পানির দরে জমি বিক্রি করেছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে সেই জমি কাঠাপ্রতি প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বরাদ্দ দিয়েছে। প্রায় ১১২ কাঠা জমি ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬ হাজার ২৫০ টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যথাযথ বিধান মেনে বাজারদর যাচাই করে এ জমি বিক্রি করলে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া যেত। অথচ সেই জমি সস্তায় বরাদ্দ দিয়ে জাগৃক প্রায় ৮৬ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে।

হাজার হাজার একর জমি বেদখল : মিরপুর এলাকায় এমন অনেক জমিই বেদখল হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব জমি ভোগ করছেন প্রভাবশালীরা। এতে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। জাগৃকের প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ-ব্যয় ও সংশ্লিষ্ট হিসাব সংক্রান্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরের কমপ্লায়েন্স অডিট প্রতিবেদনে এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বাংলাদেশ (সিএজি)। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মোট জমি ৩ হাজার ৬১৫ দশমিক ৬৫ একর, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ৪৭৪টি আবাসিক প্লটের তালিকা বা হিসাব দিতে পেরেছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। বাকি প্রায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৭১ কাঠা জমির কোনো ধরনের বরাদ্দ, বণ্টন, বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি এগুলো কর্তৃপক্ষের দখলে থাকারও কোনো প্রমাণ পায়নি সিএজি। বছরের পর বছর এসব জমি বেদখল থাকলেও উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বেদখল জমি সম্পর্কিত কোনো তথ্যও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।

কাজ না করলেও বিল পরিশোধ : এদিকে চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলেও ঠিকাদারকে ১৭ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। আর বিল পরিশোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়কর, ভ্যাট ও জামানত বাবদ ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা কর্তন দেখানো হলেও সংশ্লিষ্ট খাতে জমা না করে ব্যাংক থেকে উত্তোলনের মাধ্যমে তা আত্মসাৎ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পাদন না করায় কাজ বাতিল করা হলেও চুক্তির শর্ত মোতাবেক অবশিষ্ট কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাতিল করা কাজের জন্য আরোপ করা লিকুইডেটেড ড্যামেজেস ও অতিরিক্ত খরচের টাকা আদায় না করায় ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রকল্পে শামুকগতি : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে ‘চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে। এর আগে ২০১৮ সালে ১৬.১৯ একর জমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে দুই একর বাদ দিয়ে ১৪.১৯ একর জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি), আইএমইডি, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সার্ভে ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ছাড়পত্র গ্রহণ করে ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন ও উঁচু টিলার অংশ বাদ দিয়ে প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০২১ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজই শুরু হয়নি। ২০১৮ সালের উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পটি ৫ বছরেও বুঝিয়ে দিতে পারছে না জাগৃক।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদের গোয়ারতুমির কারণে প্রকল্পের ধীরগতি চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ছাড়পত্র দিয়েছে। এখন আবারও ছাড়পত্র চাওয়া হচ্ছে। এতে বিস্মিত হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

কারণ এক প্রকল্পে দুবার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার প্রথম থেকেই পাহাড়/নিচু টিলা না কেটে মোচনের পক্ষে মত দেন। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পাহাড় কাটার দিকেই ঝোঁক। দ্বিতীয়বার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র চাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্টদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া রাউজানে তিন ফসলি আবাদি কৃষি জমির ওপরই একটি ধরনের প্রকল্প করা হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, তাদের কৃষিজমির ওপরই প্রকল্প করার প্রবণতা বেশি। অথচ ফসলি জমি রক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।

জানা গেছে, এই প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন চাওয়া হলে প্লট সংখ্যার চেয়ে ৫-৬ গুণ বেশি আবেদন জমা হয়। এ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কর্মরত। দ্রুত প্রকল্পটি শেষ করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে এলাকাবাসী।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ, জমি অধিগ্রহণসহ সামগ্রিক বিষয়ে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। শুধু ‘চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পই নয়, মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদের অনিয়ম এবং গোয়ারতুমিতে থমকে গেছে গৃহায়নের আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মোসলেহ উদ্দীনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া নি। খুর্দেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন জবাব দেয়নি।

বক্তব্য জানতে জাগৃকের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিক ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জানা গেছে, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অধ্যয়নরত অবস্থায় মোসলেহ উদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান সরকারের আদর্শবিরোধী অবস্থানের কারণেই তিনি উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাইয়ের সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প, মিরপুর-৯ নম্বর সেকশনে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ১৫টি ১৪ তলা আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (স্বপ্ননগর-২), হবিগঞ্জের সদর উপজেলার স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকদের জন্য সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প এবং মিরপুর-১৫ সেকশনের জয়নগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতি চলছে। সব প্রকল্পেরই কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের হালিশহরে আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, ঝালকাঠির সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস, ময়মনসিংহের স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসিক ফ্ল্যাট, ঝিনাইদহের সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস এবং মিরপুর-১৬ নম্বর সেকশনের আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতি চলছে।

সূত্র বলছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পের ধীরগতি এবং মেয়াদ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মোসলেই উদ্দীন আহাম্মদ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ঠিকাদাররাও এই কর্মকর্তাদের হাতে জিম্মি।

সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এবং কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কাজে ধীরগতি এবং মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হচ্ছে ঘুষ বাণিজ্য। প্রকল্পের ঊর্ধ্বতনরা অনিয়মের উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্পে বারবার সময় বাড়াচ্ছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ঘুষ না পেলে থমকে যায় গৃহায়নের প্রকল্প নেপথ্যে মোসলেউদ্দিন

আপডেট : ০৭:৫৩:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪

সাধারণ মানুষের আবাসন নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকলেও নিজেদের উন্নয়নেই বেশি মনোযোগী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) কর্মকর্তারা। পদে পদে অনিয়ম, ফাইল নড়াতে ঘুষ, বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধারে ঢিলেমি—সবই চলে প্রতিষ্ঠানটিতে। বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক পন্থায় কোটি কোটি টাকা আয় করলেও সাধারণ মানুষ একেবারেই সেবাবঞ্চিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, বর্তমানে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাগৃকের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। সংস্থাটির চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান সব মহলে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে (জাগৃক) উচ্চমান সহকারী পদে চাকরি করেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদকও। নামে-বেনামে মালিক বনে গেছেন কয়েকশ কোটি টাকার। তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু দেলোয়ারই নন, নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট দখলের মাধ্যমে এমন অসংখ্য কোটিপতি তৈরি হয়েছে জাগৃকে। তারা নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট নেওয়ার পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামেও একাধিক বরাদ্দ নিয়েছেন।

সরকারি প্রতিষ্ঠানটির অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব প্লট-ফ্ল্যাট নেন। অথচ মন্ত্রণালয়ের বিধিতেই বলা হয়েছে, একটির বেশি কেউ বরাদ্দ নিতে পারবে না। আবার চাকরির মেয়াদ দুই বছর না হলে বরাদ্দ নেওয়া যাবে না। আবার অনেকে নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট না নিলেও নিয়েছেন স্বজনদের নামে। ঘুষ এবং তদবিরের বিনিময়ে আয় করেছেন বিপুল অর্থ। অনিয়মে গচ্চা ৮৬ কোটি টাকা: মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশনে ১১২ কাঠা জমি রয়েছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। বাজারদর অনুযায়ী ওই এলাকায় কাঠাপ্রতি জমির দাম প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু সেখানে পানির দরে জমি বিক্রি করেছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে সেই জমি কাঠাপ্রতি প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বরাদ্দ দিয়েছে। প্রায় ১১২ কাঠা জমি ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬ হাজার ২৫০ টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যথাযথ বিধান মেনে বাজারদর যাচাই করে এ জমি বিক্রি করলে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া যেত। অথচ সেই জমি সস্তায় বরাদ্দ দিয়ে জাগৃক প্রায় ৮৬ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে।

হাজার হাজার একর জমি বেদখল : মিরপুর এলাকায় এমন অনেক জমিই বেদখল হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব জমি ভোগ করছেন প্রভাবশালীরা। এতে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। জাগৃকের প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ-ব্যয় ও সংশ্লিষ্ট হিসাব সংক্রান্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরের কমপ্লায়েন্স অডিট প্রতিবেদনে এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বাংলাদেশ (সিএজি)। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মোট জমি ৩ হাজার ৬১৫ দশমিক ৬৫ একর, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ৪৭৪টি আবাসিক প্লটের তালিকা বা হিসাব দিতে পেরেছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। বাকি প্রায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৭১ কাঠা জমির কোনো ধরনের বরাদ্দ, বণ্টন, বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি এগুলো কর্তৃপক্ষের দখলে থাকারও কোনো প্রমাণ পায়নি সিএজি। বছরের পর বছর এসব জমি বেদখল থাকলেও উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বেদখল জমি সম্পর্কিত কোনো তথ্যও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।

কাজ না করলেও বিল পরিশোধ : এদিকে চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলেও ঠিকাদারকে ১৭ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। আর বিল পরিশোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়কর, ভ্যাট ও জামানত বাবদ ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা কর্তন দেখানো হলেও সংশ্লিষ্ট খাতে জমা না করে ব্যাংক থেকে উত্তোলনের মাধ্যমে তা আত্মসাৎ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পাদন না করায় কাজ বাতিল করা হলেও চুক্তির শর্ত মোতাবেক অবশিষ্ট কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাতিল করা কাজের জন্য আরোপ করা লিকুইডেটেড ড্যামেজেস ও অতিরিক্ত খরচের টাকা আদায় না করায় ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রকল্পে শামুকগতি : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে ‘চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে। এর আগে ২০১৮ সালে ১৬.১৯ একর জমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে দুই একর বাদ দিয়ে ১৪.১৯ একর জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি), আইএমইডি, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সার্ভে ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ছাড়পত্র গ্রহণ করে ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন ও উঁচু টিলার অংশ বাদ দিয়ে প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০২১ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজই শুরু হয়নি। ২০১৮ সালের উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পটি ৫ বছরেও বুঝিয়ে দিতে পারছে না জাগৃক।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদের গোয়ারতুমির কারণে প্রকল্পের ধীরগতি চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ছাড়পত্র দিয়েছে। এখন আবারও ছাড়পত্র চাওয়া হচ্ছে। এতে বিস্মিত হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

কারণ এক প্রকল্পে দুবার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার প্রথম থেকেই পাহাড়/নিচু টিলা না কেটে মোচনের পক্ষে মত দেন। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পাহাড় কাটার দিকেই ঝোঁক। দ্বিতীয়বার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র চাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্টদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া রাউজানে তিন ফসলি আবাদি কৃষি জমির ওপরই একটি ধরনের প্রকল্প করা হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, তাদের কৃষিজমির ওপরই প্রকল্প করার প্রবণতা বেশি। অথচ ফসলি জমি রক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।

জানা গেছে, এই প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন চাওয়া হলে প্লট সংখ্যার চেয়ে ৫-৬ গুণ বেশি আবেদন জমা হয়। এ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কর্মরত। দ্রুত প্রকল্পটি শেষ করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে এলাকাবাসী।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ, জমি অধিগ্রহণসহ সামগ্রিক বিষয়ে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। শুধু ‘চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পই নয়, মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদের অনিয়ম এবং গোয়ারতুমিতে থমকে গেছে গৃহায়নের আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মোসলেহ উদ্দীনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া নি। খুর্দেবার্তা পাঠালে ফিরতি কোন জবাব দেয়নি।

বক্তব্য জানতে জাগৃকের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিক ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জানা গেছে, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অধ্যয়নরত অবস্থায় মোসলেহ উদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমান সরকারের আদর্শবিরোধী অবস্থানের কারণেই তিনি উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাইয়ের সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প, মিরপুর-৯ নম্বর সেকশনে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ১৫টি ১৪ তলা আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (স্বপ্ননগর-২), হবিগঞ্জের সদর উপজেলার স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকদের জন্য সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প এবং মিরপুর-১৫ সেকশনের জয়নগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতি চলছে। সব প্রকল্পেরই কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের হালিশহরে আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, ঝালকাঠির সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস, ময়মনসিংহের স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসিক ফ্ল্যাট, ঝিনাইদহের সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস এবং মিরপুর-১৬ নম্বর সেকশনের আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতি চলছে।

সূত্র বলছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পের ধীরগতি এবং মেয়াদ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মোসলেই উদ্দীন আহাম্মদ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ঠিকাদাররাও এই কর্মকর্তাদের হাতে জিম্মি।

সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এবং কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কাজে ধীরগতি এবং মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হচ্ছে ঘুষ বাণিজ্য। প্রকল্পের ঊর্ধ্বতনরা অনিয়মের উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্পে বারবার সময় বাড়াচ্ছেন।